নিজস্ব প্রতিবেদক : রাস্তা নেই তাই আত্মীয়তা করতে চাচ্ছে না কেউ, ভালো রাস্তা না থাকায় বিয়েও হচ্ছে না! বর্ষা এলেই ডুবে যায় পানিতে এমনকি শুকনো মৌসুমেও থাকে কাঁদা আর খানাখন্দ। এমন রাস্তার জন্যই ওই এলাকায় বিবাহ যোগ্য মেয়েদের বিয়ে হচ্ছে না! পাত্রপক্ষ শুনেই পিছু হটে রাস্তা না থাকার কারণে। টাঙ্গাইলের দেলদুয়ার-মির্জাপুর উপজেলার সীমান্তবর্তী ডুবাইল ও গবড়ার সড়কের এক কিলোমিটার সড়কে স্বাধীনতার ৫৪ বছর পেরিয়ে গেলেও এখন পর্যন্ত তাদের কাছে পৌছায়নি উন্নয়নের ছোঁয়া।
স্কুলে যাওয়া তো দূর, কেউ অসুস্থ হলেও পরে যেতে হয় আরো দুশ্চিন্তায়! অসুস্থ মানুষকে কিভাবে নিবে হাসপাতালে তার জন্য। টাঙ্গাইলের গবড়া ও ডুবাইল এই দুইটা গ্রামে এমনই পরিস্থিতিতে দিন পাড় করছেন তারা।
তবে এবার সব নিরবতা ভেঙ্গে এবং সহায়তার আশা ছেড়ে গ্রামের মানুষরাই উদ্যোগ নেয় রাস্তা মেরামতের, তাও এক অভিনব উপায়ে। প্রতিদিনের বাজারের চাল কিনে ফিরেই আলাদা করে তুলে রাখেন এক মুষ্টি চাল। সপ্তাহ শেষে তা জমে যা হয় তা আবার বাজারে বিক্রি করে এভাই টাকা জমাতে থাকে গ্রামবাসী।
এক স্থানীয় জানান, প্রতি সপ্তাহে ৬০-৬৫ কেজি চাল উঠে সাড়ে ৩০০ ঘর থেকে। কেউ বেশি কেউ কম করে চাল দিয়ে থাকে। এভাবেই পাঁচ বছর ধরে চাল তুলছেন এলাকাবাসী। দুইজন লোক নিয়মিত বাড়ি বাড়ি গিয়ে চাল তুলে থাকেন।
পাঁচ বছর ধরে চাল তুলে সপ্তাহে সপ্তাহে বাজারে বিক্রি করে হয় ৪ লাখ টাকা। এর সঙ্গে সহায়তা যুক্ত হয় আরো ১ লাখ টাক। কিন্তু শেষ হয়ে আসে সেই টাকা। এখন এলাকাবাসী তাকিয়ে আছে প্রশাসনের দিকে। একটি রাস্তার জন্য প্রতিনিয়ত দুর্ভোগ পোহাতে হয় গ্রামের মানুষদের।
স্থানীয় বাসিন্দা, গ্রামবাসী ও উপজেলা প্রশাসন সংশ্লিষ্টদের সঙ্গে কথা বলে জানা গেছে, টাঙ্গাইলের মির্জাপুর, দেলদুয়ার ও বাসাইল এই তিন উপজেলার সীমান্তবর্তী গ্রাম গবড়া। গবড়া গ্রামের পাশেই রয়েছে ভাতকুড়া, ডুবাইল, মহেড়া ও স্বল্পমহেড়া গ্রাম। ভৌগলিক অবস্থানের কারণে গুরুত্বপূর্ণ হলেও এলাকাটি নিচু হওয়ায় এবং রাস্তা না থাকায় জেলা ও মূল উপজেলার সঙ্গে যোগাযোগ ব্যবস্থা অনেকটাই কঠিন হয়ে পড়ে। অথচ এই গ্রামের পাশ দিয়েই বয়ে গেছে ঢাকা-রাজশাহী-খুলনা রেল লাইন। অবহেলিত গবড়ার পূর্বে নির্মাণ হয়েছে মহেড়া রেল স্টেশন। তবে চারপাশে এতো উন্নয়ন-অবকাঠামো নির্মাণ হলেও প্রায় দুই যুগ ধরে একটি সড়ক নির্মাণ হয়নি সেখানে।
অথচ ভাতকুড়া, ডুবাইল, মহেড়া ও স্বল্পমহেড়া গ্রাম সংলগ্ন প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় কাঙ্ক্ষিত সড়কের অভাবে প্রতি বর্ষায় হাঁটু কাঁদা-পানি মাড়িয়ে চলাচল করে গ্রামবাসী। রাস্তা না থাকায় বয়স্ক, নারী, শিশুরা সারাবছরই দুর্ভোগ পোহাতে হয়। এই পরিস্থিতির মধ্যেই ২০১৯ সালে নিজেদের টাকায় সড়ক নির্মাণের সিদ্ধান্ত নেয় গ্রামের ১৫০ পরিবার। তবে তাদের কাছে নগদ টাকা টাকায় পরিকল্পনা করা হয় প্রতি মাসে নিজেদের চাষ করা মুষ্টিচাল বিক্রির টাকা জমিয়ে নির্মিত হবে সড়ক।
যেই ভাবা সেই কাজ, এভাবে প্রায় পাঁচ বছর ধরে চাল বিক্রির টাকা জমাতে শুরু করেন গ্রামবাসী। সবশেষ সম্প্রতি সময়ে জমানো সেই চাল বিক্রির টাকায় প্রায় এক কিলোমটাজুড়ে মাটি ফেলে কাঁচা রাস্তা নির্মাণ করেন গ্রামবাসী। এটি তৈরিতে ব্যয় হয়েছে প্রায় সাড়ে ৪ লাখ টাকা, যেখানে আড়াই লাখ টাকা এসেছে পাঁচ বছরের জমানো মুষ্টিচাল বিক্রির টাকা থেকে। বাকি টাকা দিয়েছেন স্থানীয় কয়েকজন গণমান্য ব্যক্তি।
![]() |
প্রায় এক কিলোমিটার এলাকায় মাটি ফেলে কাঁচা সড়কটি নির্মাণ করেছে গ্রামবাসী। ছবি: সংগৃহীত |
গ্রামের প্রবীণ বাসিন্দা আব্দুল হালিম বলেন, এই রাস্তাটির জন্য প্রায় দুই যুগ ধরে আমরা স্থানীয় মেম্বার, চেয়ারম্যান ও প্রশাসনের নিকট আবেদন করেছি। ২০০১ সালের দিকে তৎকালীন চেয়ারম্যান এটি নির্মাণের জন্য প্রস্তাব দিয়েছিলেন। এরপর থেকেই যারাই এসেছেন সবাই আশ্বাস দিয়ে গেছেন। কিন্তু রাস্তা কেউ বানায়নি। পাঁচ বছরের মুষ্টিচালের টাকা জমিয়ে আমরা কাঁচা সড়কটি নির্মাণ করেছি।
গ্রামের বাসিন্দারা জানান, ওই গ্রামে দেড়শ পরিবার রয়েছে। মূলত তাদের মুষ্টিচালের টাকা বিক্রি করেই রাস্তাটি নির্মাণ করা হয়েছে। যাদের চাষের চাল নেই, তারা মাটি দিয়েছেন। রাস্তাটি নির্মাণের জন্য গ্রামবাসীর কেউ কেউ দিয়েছেন স্বেচ্ছাশ্রম। মোট কথায় রাস্তাটি নির্মাণে কাঁধে কাঁধ মিলয়ে কাজ করেছে গ্রামের শিক্ষার্থী থেকে শুরু করে কৃষক, দোকানিসহ পুরো গ্রামবাসী। তবে কাঁচা রাস্তা নির্মাণ হওয়ার কারণে বর্ষায় সেটি চলাচল অনুপযোগী হয়ে পড়ার আশঙ্কার কথা জানিয়েছেন স্থানীয়রা। তাই সড়কটি পাকা করে দেওয়ার দাবি জানিয়েছেন তারা।
গ্রামের বাসিন্দা ও কলেজ ছাত্র সানান ও মিরাজ বলেন, পথটি অনেক নিচু ছিল। এখানে মাটি ফেলে আমরা প্রায় এক কিলোমিটার রাস্তা বানিয়েছি। কিন্তু বর্ষায় এখান থেকে মাটি সরে যেতে পারে। রাস্তাটি দ্রুত পাকাকরণে দাবি জানাচ্ছি।
এদিকে সামাজিক যোগাযোগমাধ্যমে মুষ্টিরচালে নির্মিত হচ্ছে গ্রামের কাঁচা রাস্তা এমন খবর ছড়িয়ে পড়লে বিষয়টি প্রশাসনের নজরে আসে।
সবশেষ গত রোববার (৪ মে) মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ বি এম আরিফুল ইসলাম ও দেলদুয়ার উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাব্বির আহমেদ অবহেলিত গবড়া গ্রামের এই কাঁচা রাস্তা দেখতে আসেন। এসময় সড়কটি পাকা করে দেওয়ার আশ্বাস দেন তারা। এ সময় মির্জাপুর উপজেলা প্রকৌশলী মনিরুল সাজ রিজন, উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. কহিনুর রহমান, দেলদুয়ার উপজেলা প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তা মো. রওশন করিম এবং মহেড়া ইউনিয়ন পরিষদের চেয়ারম্যান সরকার বিভাস সরকার নুপুর উপস্থিত ছিলেন।
![]() |
রাস্তার কাজ সম্পন্ন করার পর পরিদর্শনে ইউএনও। ছবি: সংগৃহীত |
মির্জাপুর উপজেলা নির্বাহী অফিসার এ বি এম আরিফুল ইসলাম ও দেলদুয়ার উপজেলা নির্বাহী অফিসার সাব্বির আহমেদ বলেন, গবড়া গ্রামাটি ৩টি উপজেলার সীমান্তবর্তী এলাকায়। কিন্তু বিভিন্ন দিক দিয়ে অবহেলিত। বিগত দিনে স্থানীয় মেম্বার-চেয়ারম্যানও বিষয়টি প্রশাসনকে তেমনভাবে উপস্থাপন করেননি। গ্রামবাসী নিজেদের উদ্যোগে মুষ্টির চালে চলাচলের জন্য যে কাঁচা রাস্তা নির্মাণ করেছে এটা প্রশংসার দাবিদার। আমরা এলাকা ঘুরে দেখেছি, রাস্তাটি পাকা হওয়া খুব জরুরি। উপজেলা প্রকৌশলী অফিস ও প্রকল্প বাস্তবায়ন কর্মকর্তার অফিস এবং ঊর্ধ্বতন কর্তৃপক্ষের সঙ্গে কথা বলে দ্রুত রাস্তাটি পাকা করে দেওয়ার উদ্যোগ নেওয়া হচ্ছে।