মোঃ হাবিব মিয়া, নিকলী (কিশোরগঞ্জ) :
সমাজ উন্নয়নে অসামান্য অবদান রাখায় জয়িতায ২০২২ সালে পুরস্কারে ভূষিত হলেন কিশোরগঞ্জের নিকলী উপজেলার পাঁচ সূর্য কন্যা। জয়িতারা উন্নয়ন ও ক্ষমতায়নের মূর্ত প্রতীক। নিজেরদের প্রতিকূলতাকে ঝয় করে এবং অদ্যম ইচ্ছা শক্তিকে সম্বল করে নারী উন্নয়নে সমাজে নিজের জায়গা করে নিয়েছেন তারা। নিকলী উপজেলা মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তা কার্যালয় পাঁচটি ক্যাটাগরিতে এসব জয়িতা নারীদের নির্বাচিত করে পুরস্কারে ভূষিত করেছেন। যেসব ক্যাটাগরিতে জয়িতাদের পুরস্কার ভূষিত করেছেন- (১) অর্থনৈতিকভাবে সাফল্য অর্জনকারী নারী, নিকলী সদর ইউনিয়নের নগর গ্রামের শায়লা আক্তার, সারা পৃথিবী ও বাংলাদেশে যখন কোভিড ১৯ মহামারীতে বিপর্যস্ত সে সময় আমার বাবা মারা যায় তখন আমি ও আমার পরিবার কষ্টে জীবন যাপন করি । তখনই মনে মনে তখন সিদ্ধান্ত নেই আমাকে পরিবারের হাল ধরতে হবে। তখন আমি মাত্র ৫০০০ টাকা হাতে নিয়ে কাজ শুরু করি । শুরুতে মহিলা বিষয়ক কর্মকর্তার কার্যালয়ে তিন মাসের সেলাই প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি এবং পরবর্তীতে মহিলা বিষয়ক অধিদপ্তর ও উপজেলা পরিষদের মাধ্যমে ব্লক ও হ্যান্ড প্রশিক্ষণ গ্রহণ করি। পরবর্তীতে আমার ফেইজবুক আইডি থেকে অনলাইন পেইজে মাধ্যমে ব্যবসা শুরু করি ছোট পরিসরে। আস্তে আস্তে ব্যবসার পরিসর বৃদ্ধি পায়। বিভিন্ন অফিস, স্কুল কলেজ এবংএলাকার লোকজন ও অর্ডার করে যা আমি তাদের অর্ডার অনুযায়ী সাপ্লাই করি। এবং খুব ভালো রিভিউ পাই পাশাপাশি দেশের বিভিন্ন জায়গায় থেকে অর্ডার পাই। বর্তমান আমার ব্যবসায়ের মূলধন ১,০০০০০ লক্ষ টাকা মাত্র। প্রতি মাসে আমার প্রায় লাভ হয় ৩০-৪০ হাজার টাকা। এখন আমি অনেকটাই স্বাবলম্বী। আমি নারীদের উন্নয়নের কথা ভেবে বিভিন্ন গ্রামের মেয়েদেরকে প্রশিক্ষণ দিয়ে থাকি।(২) শিক্ষা ও চাকুরীক্ষেত্রে সাফল্য অর্জনকারী নারী, দামপাড়া ইউনিয়নের পূর্বহাটি গ্রামের সুমাইয়া আক্তার,তিনি ২০০৯ সালে দামপাড়া কারার মাহতাব উদ্দিন উচ্চ বিদ্যালয় থেকে জিপিএ ৫ পেরে এসএসসি পাশ করেন। ২০১১ সালে পৌর মহিলা কলেজ কিশোরগঞ্জ থেকে জিপিএ ৫ পেয়ে এইচ এস সি পাস করেন। অতঃপর তিনি শেরেবাংলা কৃষি বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকায় কৃষি বিষয়ে অনার্সে ভর্তি হন এবং২০১৬ সালে সিজিপিএ ৩.৬৮ পেয়ে কৃষি বিষয়ে অনার্স পাশ করেন। তারপর তিনি একই বিশ্ববিদ্যালয়ে কৃষি বিষয়ে মাস্টার্স ভর্তি হন এবং ২০২০ সালে সিজিপিএ ৩.৬৯ পেয়ে কৃষি বিষয়ে মাস্টার্স পাশ করেন। তিনি স্নাতকোত্তর ডিগ্রি অর্জন করার পর বিসিএস পরীক্ষার জন্য প্রস্তুতি গ্রহন করেন। অতঃপর তিনি৪০ তম বিসিএস কৃষি ক্যাডার পরীক্ষায় উত্তীর্ণ হন।তার পিতা একজন কৃষক ও বর্ষা মৌসুমে নৌকা চালিয়ে জীবিকা নির্বাহ করায় পরিবারে তেমন আর্থিক সচ্ছলতা ছিল না। তিনি টিউশনি করে লেখাপড়ার খরচ যোগাতেন। তিনি তার দৈনন্দিন অবসর সময়ে বিনা পারিশ্রমিকে তার বাড়ির আশেপাশে স্কুল কলেজে পড়ুয়া মেয়েদের পড়াশুনা তদারকি করেন। এ রকম পল্লী অঞ্চলে পড়াশুনা তিনি লেখাপড়া করার জন্য তাকে অনেক সংগ্রাম করতে হয়েছে করতে অনেক বাধার সম্মুখীন হয়েছেন। প্রার্থীর ইচ্ছা ছিল গ্রাম গঞ্জের কৃষকদের জন্য কিছু করা। কৃষকদের সাথে সম্পৃক্ত থেকে তাদের অর্থনৈতিকভাবে সমৃদ্ধি করে পিছিয়ে পড়া জনগোষ্ঠির
অর্থনৈতিক নিরাপত্তা নিশ্চিত করা।তিনি বিশেষ করে পল্লী অঞ্চলের কৃষকদের সাথে কাজ করা এবং তাদের অর্থনৈতিক মুক্তি লাভ প্রদানই তার মূল লক্ষ্য।
(৩) সফল জননী নারী, নিকলী সদর ইউনিয়নে বর্মন পাড়া গ্রামের সরস্বতী বর্মন, স্বামী ছোট-খাট ব্যবসা করেন। ব্যবসায় যা আয় হয় তা দিয়ে কোন রকমে সংসার চলে। ৭ জন ছেলে মেয়ে নিয়ে অভাব অনটনে দিন কাটতে হয়েছে।সবকটি ছেলেমেয়েকে স্কুল কলেজে লেখাপড়া করানো স্বামীর একার পক্ষে খুব কষ্টে দিন যাপন করতে হয়েছে। তারপরও তিনি হাল ছাড়েননি।অভাব অনটনের মধ্যে সকল সন্তানদের লেখাপড়া চালিয়ে নিয়েছেন।তাঁর ঐকান্তিক প্রচেষ্টায় এবং অদম্য সাহসিকতায় সকল সন্তানদের লেখাপড়া প্রাণপন চেষ্টা করেছেন।অভাব অনটনের কারণে বিভিন্ন সময় সামাজিকভাবে অনেক ঘাত-প্রতিঘাত সহ্য করতে হয়েছে। ১ম সন্তান সুকুমার বর্মন, প্রাইম বিশ্ববিদ্যালয়, ঢাকা থেকে মাস্টার্স পাস করে বর্তমানে স্থাস্থ্য সহকারী পদে . নিকলী উপজেলায় কর্মরত আছেন।২য় সন্তান রাজকুমার বর্মন, কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারী কলেজ থেকে এইচ, এস, সি পাস করে বর্তমানে মালয়শিয়ার প্রবাসি । ৩য় সন্তান সজল বর্মন, কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারী কলেজ থেকে বি. এ. এবং দারুল ইহসান বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এড পাস করে বর্তমানে যাইটধার সরকারী প্রাথমিক বিদ্যালয়, নিকলীতে সহকারী শিক্ষক হিসেবে কর্মরত আছেন। ৪র্থ সন্তান ঝুটন বর্মন, কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারী কলেজে থেকে মাস্টার্স পাস করে বর্তমানে সিনিয়র অফিসার হিসেবে সোনালী ব্যাংক, নিকলী শাখায় কর্মরত আছেন। ৫ম সন্তান সুরভী বর্মন, ভাওয়াল বদরে আলম সরকারী কলেজ থেকে মাস্টার্স পাস করে বর্তমানে কুশা‘সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়, নিকলীতে কর্মরত আছেন। ৬ষ্ট সন্তান উজ্জ্বল বর্মন, কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারী কলেজ থেকে মাস্টার্স পাস করে বর্তমানেএনআরবিসি ব্যাংকে জুনিয়র অফিসার হিসেবে কর্মরত আছেন। ৭ম সন্তান উৎপল বর্মন, কিশোরগঞ্জ গুরুদয়াল সরকারী কলেজ থেকে সদ্য মাস্টার্স পাস করে।(৪) নির্যাতনের বিভীষিকা মুছেনতুন উদ্যমে জীবন করেছেন যে নারী নিকলী সদর ইউনিয়নে কালশাহাটি গ্রামের মোছাঃ রুমা আক্তার, তিনি ৫ম শ্রেনী পর্যন্ত লেখাপড়া করেন। তাকে ২০০৭ সালে বিয়ে দিয়ে দেওয়া হয়। তিনি লেখাপড়া করার ইচ্ছা থাকা সত্ত্বেও বাবার অভাব অনটনের সংসারে লেখাপাড়া আর করা হয়নি।তার স্বামী বর্গাচাষী ছিলেন। বিয়ের ২ বছর পর ২০০৯ সালে হ্যাপাটাইটিস বি রোগি আক্রান্ত হয়ে মৃত্যু বরন করেন। তখন তিনি ৭ মাসের অন্তসত্তা ছিলেন। তারপর তার কন্যা সন্তান জন্ম হয়।স্বামী না থাকায় তিনি আরো বেশী অভাবে পড়েন। স্বামী মারা যাবার পর শশুর বাড়ির লোকজন বিভিন্নভাবে শারিরীক ও মানসিক নির্যাতন করতে থাকেএক পর্যায়ে তিনি স্বামীর বাড়ি থেকে বাবার বাড়ি চলে আসেন। শশুর বাড়ির লোকজনের অত্যাচারে তিনি বাবার বাড়ি চলে আসেন। বাবার সংসারে অভাব অনটন লেগেই থাকত। ব্রাক, নিকলী শাখা কর্তৃক আয়োজিত বাল্য বিয়ে ও নারী নির্যাতন সম্পর্কিত গণ নাটকে অভিনয়ের সুযোগ পান।
তিনি তার বাবার বাড়ীর আশে-পাশের লোকজনের কাপড় সেলাই করে মুটামুটি ভাল আয়-রোজগার করতে থাকেন।তিনি ইতোমধ্যে আরো কয়েকজন মহিলাকে সেলাই প্রশিক্ষণ প্রদান করেন।তিনি আরো দু'টি সেলাই মেশিন কিনে প্রশিক্ষণ প্রাপ্ত মহিলাদের মাধ্যমে সেলাইয়ের কাজ বৃদ্ধি করেন। তিনি তার বাবার বাড়িতে একটি কাপড়ের দোকান দেন। এতে তিনি বর্তমানে প্রতিষ্ঠিত একজন ব্যবসায়ী ।তার আয়-রোজগারে নিজে এবং বাবার সংসার ভালভাবে চলছে। তিনি উপজেলা মহিলা বিষয়ক অফিস, নিকলীতে জানুয়ারী থেকে মার্চ ২০২২ মেয়াদে ১২তম ব্যাচে ক্রিস্টাল সো-পিস ও মোমবাতি প্রস্তুতকরণ ট্রেডে প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন। ২০০৬ সালে উপজেলা সমাজসেবা অফিস, নিকলী হতে দর্জি বিজ্ঞান বিষয়ে প্রশিক্ষণ গ্রহন করেন। (৫) সমাজ উন্নয়নের অসামান্য অবদান রেখেছে যে নারী, উপজেলা গুরুই ইউনিয়নের হিলচিয়া গ্রামের মোছাঃ লিজা পারভিন, তিনি ২০১৬ সালে প্রথম এবং ২০২১ সালে দ্বিতীয়বারের মত ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনে সংরক্ষিত মহিলা আসনে জনগণের ভোটে নির্বাচিত হন।তিনি ছোট বেলা থেকেই নিজেকে জনগনের সেবা করার জন্য ইচ্ছাপোষন করেন। তার সেই ইচ্ছা থেকেই সংরক্ষিত মহিলা সদস্য আসনে প্রতিদ্বন্ধিতা করেন।জনগণের দুঃখ দুর্দশা লাগবের জন্য তিনি দিন রাত কাজ করে যাচ্ছেন।
ইউনিয়ন পরিষদ নির্বাচনের ২ বার প্রতিদ্বন্ধিতা করে ২ বারই বিপুল ভোটে বিজয়ী হন।পরিষদে সংরক্ষিত আসনের মহিলা সদস্য নির্বাচিত হয়ে এলাকায় ড্রেইন, কালভার্ট, রাস্তা, টিউবওয়ের ইত্যাদি এলাকার উন্নয়নমূলক কাজ করে যাচ্ছেন। দরিদ্র মহিলাদের মাঝে স্যানিটারি ন্যাপকিন, সেলাই মেশিন বিতরণ করেছেন। ইউনিয়নের ওয়ার্ডসভা ও সচেতনতা মূলক উঠান বৈঠকের মাধ্যমে বাল্য বিবাহ প্রতিরোধ, পারিবারিক বিরোধ নিরসন ও যৌতুক প্রথা বিরুদ্ধে সোচ্ছার আছেন। তিনি এ পর্যন্ত তার নির্বাচনী এলাকায় ০৬ টি বাল্য বিয়ে প্রতিরোধ করেছেন।
তার নিজস্ব গরুর ফার্ম আছে। তার ফার্মে এখন মোট ৭ টি গরু আছে। তন্মধ্যে ৩টি গাভী আছে যা
দ্বারা দুধ সংগ্রহ করে বিক্রি করেন এবং ৪ টি ষাড় মোটাতাজা করনের জন্য পালন করছেন। যা দ্বারা
স্বামীর সংসারে ছেলে মেয়েদের লেখাপড়ার খরচ চালিয়ে যাচ্ছেন । সমাজ উন্নয়নে তিনি দিন রাত কঠোর পরিশ্রম করে যাচ্ছেন ।