Daily News BD Online

বিবাহ বিচ্ছেদের পর কার ট্রমা বেশি হয়—পুরুষ নাকি নারীর?

অধ্যাপক ডা. সানজিদা শাহরিয়া 

বিবাহ বিচ্ছেদের পরবর্তী সময়ে পুরুষের তুলনায় নারীকে অধিক মাত্রায় অসামাজিক আঘাতের ভেতর দিয়ে যেতে হয়। কারণ পুরুষতান্ত্রিক মনোভাবের কারণে সংসার রক্ষার দায় অধিকাংশ ক্ষেত্রেই চাপিয়ে দেওয়া হয় নারীদের ওপর। বাংলা একটি প্রবাদ আছে, ‘সংসার সুখের হয় রমণীর গুণে’। এটুকু সবখানে উল্লেখ করা হলেও এর পরবর্তী লাইন, ‘গুণবান পতি থাকে তার সনে’ বাক্যটি অধিকাংশ ক্ষেত্রেই অনুউল্লেখিত থাকে।

বিবাহ বিচ্ছেদের পর নারীর যে ট্রমার ভেতর দিয়ে যেতে হয় সেগুলোকে আমি শারীরিক, মানসিক সামাজিক ও আধ্যাত্মিক—এই চারটি অংশে ভাগ করব।

শারীরিক ট্রমা বলতে আসলে কী বোঝাতে চাচ্ছি? কায়িক পরিশ্রম বেড়ে যাচ্ছে। যৌ*ন জীবনে স্থবিরতায় অক্সিটোসিন হরমোন উৎপাদন কমে যাচ্ছে। এতে মানসিক চাপ বাড়ছে। মানসিক চাপ দৈহিক কিছু লক্ষণ তৈরি করে, যা সাইকো অর্থাৎ সাইকোলজিক্যাল এবং সোমাটিক মানে দৈহিক, মনোদৈহিক চাপ তৈরিতে ভূমিকা রাখে।

এবার আসি মানসিক চাপের ক্ষেত্রে। এ সময় নারী মানসিকভাবে শক্ত থাকতে চাইলেও চারপাশের পরিবেশ কিন্তু তাকে শক্ত থাকতে দিতে চায় না। নারীকে বারবার প্রশ্ন করা হয়, কি কারণে তালাক হলো? অথচ এই প্রশ্ন যে কতটা অস্বাভাবিক, তা আশেপাশের মানুষ বোঝেন না। এ ছাড়া পেশাগত জীবনে আমি দেখেছি, একজন তালাকপ্রাপ্ত নারীর সঙ্গে তার বান্ধবীরা কথা বলা পর্যন্ত বন্ধ করে দেয়। যদি সেই নারীর প্রতি বান্ধবীর স্বামীরা অনুরক্ত হয়ে পড়েন, ওই ভয়ে। আবার পেশাগত জীবনে তালাকপ্রাপ্ত নারীকে অশ্লীল ইঙ্গিত বা মধ্যরাত্রের টেক্সটের সম্মুখীন হতে হয়।  

এবার আসি সামাজিক ক্ষেত্রে। আমাদের চারপাশের মানুষগুলোই তো সমাজ। এখনো আমাদের সমাজ মনে করে, পুরুষ রাগলে ঠিক আছে, কিন্তু নারী রাগলেই সমস্যা। কাজেই নারী কেন মানিয়ে–গুছিয়ে সংসার টেকাতে পারল না, তার দায়ভার একান্তই নিজেকে বহন করতে হয়। আবার তাঁর সন্তান সঙ্গে থাকলে তো কথাই নেই। আত্মীয়-স্বজনদের থেকেও শুনতে হয় নানা কথা।

বিবাহ বিচ্ছেদের পরে সম্ভবত সব থেকে বেশি ক্ষতি হয় আধ্যাত্মিক স্বাস্থ্যের। আধ্যাত্মিকতা মানে তিনটা জিনিস। 

প্রথমত, আমার সঙ্গে আমার নিজের সম্পর্ক কী?

কখনো কখনো আমরা প্রশ্ন করি—আমি কে? কেন আমি এই পৃথিবীতে এসেছি? আমার জীবনের উদ্দেশ্য কী? ইত্যাদি প্রশ্নগুলো হলো নিজের সঙ্গে নিজের আন্তঃসম্পর্ক।

দ্বিতীয়ত, আমার সঙ্গে অন্যের সম্পর্ক কী? 

কখনো কখনো আমরা প্রশ্ন করি, অমুক মানুষটির সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী? অথবা চিপসের প্যাকেট যেখানে–সেখানে না ফেলে পরিবেশ দূষণ রোধ করার জন্য ডাস্টবিনে ফেলি। কখনো বা গ্রীষ্মের অত্যধিক গরমে বারান্দার কোণে পাখির জন্য পানি রেখে দেয়। এই সবগুলোই নির্দিষ্ট করে অন্যের সঙ্গে আমার সম্পর্ক। 

তৃতীয়ত, আমার সঙ্গে এই মুহূর্তের সম্পর্ক কী?

এই মুহূর্তের সঙ্গে আমার সম্পর্ক কী? আপনারা সবাই করোনাকালীন একটা ভিডিও নিশ্চয়ই দেখেছেন, যেখানে টয়লেট পেপারের জন্য মানুষ মারামারি করছে। যেটা এখন হাস্যকর মনে হলেও, ঠিক ওই মুহূর্তে কতিপয় মানুষের কাছে মনে হয়েছিল টয়লেট পেপার সংগ্রহ করাটা খুবই জরুরি। অথবা আমি নিজে জানি না, আগামীকাল ঢাকা শহরে যদি একটা রিখটার স্কেলে  ৮ মাত্রার ভূমিকম্প হয়, তাহলে আমি কি করব? 

কাজেই আবার ফেরত আসি মূল প্রসঙ্গে। বাংলাদেশে নারীদের গত ২০ বছরে ক্ষমতায়নের জন্য যতটুকু এগিয়ে দেওয়া হয়েছে, ঠিক একজন পুরুষকে এই ক্ষমতায়নপ্রাপ্ত নারীকে গ্রহণের জন্য পরিবার থেকে ততটুকু শিক্ষা কি দেওয়া হয়েছে? নাকি এখনো আমরা ছেলেদের কাজ, মেয়েদের কাজ বলে ভিন্নতা করি? যেমন রান্না করা, ঘর মোছা, কাপড় কাচা—এগুলো বেসিক স্কিলের মধ্যে পড়ে। শ্রম বিভাজন শুধু কি বুদ্ধিভিত্তিক? শুধু কি কায়িক শ্রমভিত্তিক? আমরা কি এখনো কন্যা শিশুটিকে অল্প দামের স্কুলে পড়িয়ে বড় পরিমাণ অর্থ রেখে দেচ্ছি পুত্র সন্তানকে বেসরকারি বিশ্ববিদ্যালয় পড়ানোর জন্য? 

উত্তর আপনার চোখের সামনেই! নিজের চোখে আয়না ধরুন। দেখুন আপনার চোখ কী বলে? 

লেখক: চিকিৎসক, কাউন্সিলর, সাইকোথেরাপি প্র্যাকটিশনার, ফিনিক্স ওয়েলনেস সেন্টার, বাংলাদেশ

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন