৫ই আগস্টের পর থেকে নানা কারণে দেশ আন্দোলন- সহিংসতায় উত্তাল রয়েছে। চারিদিকে শুধু মিটিং, মিছিল আর আন্দোলন। মানুষ জনের মধ্যে যেন দাবি আদায়ের এক প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছে। তাছাড়াও দিন দিন বাড়ছে অপরাধের প্রবণতা। আইন শৃঙ্খলা বাহিনীর তেমন কার্যক্রম পরিলক্ষিত হচ্ছে না। বলা চলে অনেকটা নীরব ভূমিকাই পালন করছে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী। সে সুযোগেই দেশের প্রতিটি শহরে বেড়েছে চুরি ডাকাতি ও ছিনতাই এর মত ঘটনা।
রাশেদ সিলেট শহরে থাকে। তার জীবনের পুরোটা সময় কেটেছে এই শহরেই। ছোটবেলা থেকে লেখাপড়া স্কুল কলেজ এই সিলেট শহরেই। তবে কলেজ শেষ করার পর রাশেদের আর লেখাপড়া করা হয়নি অর্থনৈতিক সংকটের কারণে। যদিও সে জাতীয় বিশ্ববিদ্যালয় অনার্সে ভর্তি হয়েছিল কিন্তু সেটি শেষ করতে পারেনি।
কলেজ জীবন থেকেই রাশেদ টিউশনি ও বিভিন্ন খন্ডকালীন চাকরি করে উপার্জন করা শুরু করে।
বর্তমানে রাশেদ শহরের একটি বিল্ডিং এর পাঁচ তলায় ছোট্ট একটি ফ্ল্যাট নিয়ে ভাড়া নিয়ে থাকে। রাশেদের স্ত্রী রত্না ও একমাত্র মেয়ে আনিকা। সিলেট শহরে রাশেদ একটি বেসরকারি কোম্পানিতে মার্কেটিং অফিসার হিসেবে কর্মরত আছে। যদিও তার বেতন খুবই সামান্য এবং এই অল্প টাকা দিয়ে সংসারে টানাটানি থেকে যায়। তবুও সে তার মেয়েকে ভালো একটি স্কুলে ভর্তি করিয়েছে। এ বছর আনিকা নবম শ্রেণিতে ভালো ফলাফল করে উত্তীর্ণ হয়েছে। বলতে গেলে আনিকার লেখাপড়ার পিছনেই রাশেদের আয়ের বেশ কিছু টাকা খরচ হয়ে যায়।
চাকরির পাশাপাশি তাই সে কিছু একটা করার কথা ভাবছে। ছাত্র জীবন থেকে রাশেদ রাজনীতির সাথে জড়িত ছিল। স্থানীয় রাজনীতির সাথেও সে টুকটাক জড়িত।
বৈষম্য বিরোধী ছাত্র আন্দোলনের সময় রাশেদ ছাত্রদের সাথে সিলেট শহরে আন্দোলনে সরাসরি ভূমিকা রাখায় মোটামুটি ভালো পরিচিত হয়ে ওঠে।
বরাবরের মতোই ০৭.০৪.২০২৫ তারিখে সে অফিসে যাওয়ার জন্য রেডি হয়েছে। সে প্রতিদিন অফিসে যাওয়ার সময় মেয়েকে স্কুলে দিয়ে যায়।
আনিকার সাথে তার সাথে সম্পর্কটা একদম বন্ধুর মত।
ছোটবেলা থেকেই সে মেয়ের সাথে বন্ধুর মতো আচরণ করেছে। মেয়েকে যথাসম্ভব বোঝার চেষ্টা করেছে। আনিকার সকল প্রয়োজনে রাশেদ তার পাশে থেকেছে।
হাজার কষ্ট হলেও মেয়ের সকল প্রয়োজন যতটুকু সম্ভব পূরণ করার চেষ্টা করেছে।
আনিকার কাছে ছোটবেলা থেকেই তার বাবা হিরো। একদম গল্পের হিরোর মত। যে কোন সমস্যার সমাধান হোক কিংবা তার যে কোন চাহিদা হোক, কোথাও ঘুরতে যাওয়া হোক কিংবা কোন রেস্টুরেন্টে খেতে যাওয়া হোক । সাইকেল চালানো, সাঁতার শেখা অথবা সিনেমা হলে যে মার্বেল বা ডিসি কমিক্সের কোন সিনেমা দেখা।
আনিকা তার জীবনের সব স্বপ্ন পূরণ করতে পেরেছে বাবার জন্য। আনিকার জীবনে খুব বেশি বন্ধুর প্রয়োজন হয়নি। তাই বাবাই তার কাছে হয়ে উঠেছে তার জীবনের সবচেয়ে ভালো বন্ধু।
-রাশেদ আনিকা কে ডেকে বলে আজকে স্কুলে যাবে না।
-না বাবা আজ স্কুলে যাব না তুমি জানো না আজ সারা দেশে নো ওয়ার্ক নো ক্লাস কর্মসূচি চলছে। আমি আজকে স্কুলে যাব না। তুমি দেখছো না কিভাবে ইসরাইল গাজায় হামলা চালাচ্ছে। আমরা আজকে বিক্ষোভ মিছিল করবো। আর ভালো কথা বাবা আমার কিন্তু জুতো ছিড়ে গিয়েছে। আমার জন্য এক জোড়া জুতো নিয়ে এসো। তা না হলে আমি কালও স্কুলে যেতে পারবো না।
-আচ্ছা ঠিক আছে আনিকা আমি তাহলে বের হচ্ছি সাবধানে থেকো। আর আসার সাময় আমি তোমার জন্য জুতো নিয়ে আসবো। এ বলে রাশেদ অফিসের উদ্দেশ্যে ঘর থেকে বের হয়ে যায়।
বের হতে হতে সে রত্নাকে বলে আজ আমার আসতে দেরি হতে পারে অফিসের পর আমাদের দলের একটি মিটিং রয়েছে সেখানে একটু কাজ আছে তাই ফিরতে রাত হবে।
রাশেদ অফিসে এসে ফিল্ড ভিজিট এর জন্য অফিস থেকে বের হয় এবং সে শহরের বাজারের দিকে যেতে থাকে। কিন্তু ততক্ষণে স্কুল-কলেজ থেকে অনেক ছাত্রই বিক্ষোভ মিছিল নিয়ে বের হয়েছে এবং তাদের সংখ্যা নেহাতি কম নয় সেই সাথে তাদের সাথে সাধারণ মানুষের যোগ দিয়েছে। দুপুর ১২ টা নাগাদ মিছিলে মিছিলে শহরের মোড় জন সমুদ্রে পরিণত হয়েছে। ইসরাইলের বিরুদ্ধে ছাত্র জনতা এক হয়ে বিক্ষোভ করছে স্লোগান দিচ্ছে এ যেন এক আবেগ ঘন মুহূর্ত।
রাশেদ অফিসে ফোন দেয় এবং তার সিনিয়র বসকে জানায়
স্যার আজ তো শহরের পরিস্থিতি খুবই খারাপ মনে হয় ফিল্ড ভিজিট করতে পারবো না। আন্দোলন-বিক্ষোভে ছাত্র জনতায় আমার ফিল্ড এলাকা ভরে গিয়েছে।
ঠিক আছে রাশেদ শহরের যেহেতু এরকম অবস্থা আর তুমি আজকে ফিল্ড ভিজিট করো না, তবে একটু অবজারভেশনে রেখো আর আমাকে আপডেট জানিও তুমি তোমার ফিল্ড এরিয়াতেই থেকো।
রাশেদের কাজ না থাকায় সে ছাত্র জনতার বিক্ষোভ মিছিলে অংশগ্রহণ করল এবং সেখাকার সার্বিক পরিস্থিতি দেখতে লাগলো।
দুপুর দুইটা নাগাদ রাশেদ শহরের সেই এলাকাতেই ছিল এমন সময় তার মোবাইলে কল আসে।
দলের সিনিয়র নেতা রফিক জানায় তারা শহরের দিকে আসছে যেখানে বিক্ষোভ করছে ছাত্র জনতা সে বিক্ষোভ তারা অংশ নেবে রাশেদ যেন সেখানেই থাকে।
রাশেদ বলল ভাই আমি এখানেই আছি আজকে আমার তেমন কাজ নেই আপনারা আসেন এখানে পরিস্থিতি খুবই উত্তাল রয়েছে।
কিছুক্ষণের মধ্যেই দলীয় নেতা কর্মীরা চলে আসে এবং রাশেদ তাদের সাথে যোগ দেয়। দলের লিডার রফিক ভাই বলেন তোমাদের জন্য একটি নির্দেশনা রয়েছে এবং আজকে আমাদের একটি প্ল্যান রয়েছে।
রাশেদ বলে কি প্লান ভাই?
রফিক ভাই বলে আজকের এই দিনটাই আমাদের জন্য সুযোগ এই সুযোগ আমাদের কাজে লাগাতে হবে। আমরা ছাত্র জনতার সাথে এক হয়ে ইসরাইলি পণ্য বর্জনের স্লোগান দিব এবং বাজারে যেসব দোকানে ইজরাইলি পণ্য বিক্রি করা হয় সেগুলো ভেঙে ফেলবো।
-রাশেদ বলে এরকম করা কি ঠিক হবে রফিক ভাই?
-রাশেদ তুমি আর কথা বাড়িও না, এখন আমাদের হাতে একদম সময় নেই চলো আমরা এখনি এটা শুরু করবো। এই বলে রফিক ভাই দলের ছেলেপেলেদের নিয়ে স্লোগান দিতে দিতে মূল বিক্ষোভের দিকে এগিয়ে যায়।
রাশেদ ও দলের সাথে এগিয়ে যায়।
মূল বিক্ষোভে রফিক ভাই গিয়ে কথা বলা শুরু করে এবং সবাইকে ইসরাইলি পণ্য বয়কট করার আহ্বান জানায়।
রফিক ভাইয়ের আহ্বানে সবাই সাড়া দেয়।
রফিক ভাই বলে আমার সংগ্রামী ছাত্র জনতা বন্ধুরা আমরা প্রতিবাদ হিসেবে এখন থেকে ইসরাইলি সব পন্য বর্জন করছি এবং আমাদের সামনে ইসরাইলী পণ্যের দোকানগুলো রয়েছে সেগুলো সব ভেঙে ফেলবো।
এতে আরো উত্তেজনা ছড়িয়ে যায় এবং সবাই দোকান ভাঙচুর শুরু করে। এক পর্যায়ে দোকান ভেঙে সবাই দোকানের ভিতরে ঢুকে পড়ে এবং লুটপাট করতে শুরু করে।
এত দ্রুত সবকিছু ঘটে যায় রাশেদ কিছু বোঝার আগেই সাথে একটি জুতার দোকানে ঢুকে যায় এবং সেখানে দেখে সবাই যে যার মত জুতা নিয়ে যাচ্ছে। তখনই রাশেদের মনে পড়ে আনিকার তো জুতো নেই। তার সাথে আর কোন কিছু না ভেবে কিডস জোনের দিকে গিয়ে একজোড়া জুতা তার প্যান্টের পেছনের দুই পকেটে ভরে।
ভাঙচুরের এক পর্যায়ে আইন শৃঙ্খলা বাহিনী চলে আসে তখন রফিক ভাই দ্রুত সবাইকে সেখান থেকে পালিয়ে যেতে বলে। দলের অন্যান্য ছেলেদের সাথে রাশেদও দ্রুত সেখান থেকে সটকে পড়ে।
সন্ধ্যা নাগাদ পুরো ঘটনাটি দেশজুড়ে ভাইরাল হয়ে যায় এবং বিভিন্ন ছবি ও ভিডিও ক্লিপস ছড়িয়ে পড়ে।
সেই সাথে রাশেদের সেই জুতো পকেটে ভরা দৃশ্যটিও ভাইরাল হয়ে যায়।
দলের সবাই রাশেদকে বলে আজকে তুমি বাসায় না গিয়ে আমাদের সাথে থাকো। যেহেতু ভিডিও ক্লিপ ভাইরাল হয়েছে সেহেতু গ্রেপ্তার করার জন্য তোমার বাসায় পুলিশ যেতে পারে। আর তোমার মোবাইল নাম্বারও বন্ধ করে দাও। তা না হলে পুলিশ সিম থেকে লোকেশন ট্র্যাক করে করে ধরে ফেলতে পারে।
রাশেদ রত্নাকে মোবাইলে রাতে আসবোনা বলে একটি এসএমএস দিয়ে মোবাইল ফোনটি সুইচ অফ করে দেয়।
রত্না আনিকাকে নিয়ে জড়োসড়ো হয়ে বসে আছে। একের পর এক মোবাইলে কল আসছে। ভিডিও ফুটেজের লোকটি রাশেদ কিনা আত্মীয়-স্বজনরা সবাই জানতে চাচ্ছে। দরজা একটু পরপর কলিং বেল বাজছে প্রতিবেশীরা সবাই এসে জিজ্ঞেস করছে ভাইরাল ভিডিওটির ব্যাপারে। এদিকে রাশেদের ফোন বন্ধ সন্ধ্যা গড়িয়ে রাত হয়ে যাচ্ছে রাশেদের কোন খবর নেই।
আনিকা রত্নাকে বারবার জিজ্ঞেস করেও কোন সদুত্তর পেল না। সে রাতে না খেয়ে রুমের দরজা লাগিয়ে কাঁদতে কাঁদতে ভাবতে লাগলো। রত্ন তাকে আর রাতে ডাক দেয়নি।
সারারাত আনিকা ঘুমাতে পারল না প্রত্যেকটা মানুষের জিজ্ঞাসা তার বুকে তীরের মত বিধতে লাগলো।
সে বোঝার পর থেকে তার বাবার কাছ থেকে কখনোই অতিরিক্ত টাকা চাইনি। কোন আবদার করেনি বাবার কষ্ট হবে বলে। সে তার বাবার কষ্টটা বুঝতো তার বাবার উপার্জন কম ছিল সেটাও সে ভালো করে বুঝতো।
কিন্তু সেই বাবা কিভাবে এমন করল! যে বাবা তার কাছে সুপার হিরো। ভাইরাল হওয়া ভিডিওটি সে দেখেছে প্রথম দেখাতেই সে তার বাবাকে চিনতে পেরেছে। তারপরও প্রতিবেশীরা যখন বাসায় আসছিল এবং তার মাকে জিজ্ঞেস করছিল ভিডিওর লোকটি রাশেদ কিনা এ সময় প্রতিটা কথাতেই আনিকার হৃদয়ে রক্তক্ষরণ হচ্ছিল। তার কাছে মনে হচ্ছিল তার কলিজা ছিড়ে টুকরো টুকরো হয়ে যাচ্ছে।
যেন এক অজানা তীব্র ব্যথা নিয়ে সে অনন্তকাল পার করছে তার জন্য সকাল অনেক দীর্ঘ। আর সে সেই সকাল কোনদিনও দেখতে চায় না। সে চায় না আর কোনদিন সকাল না হোক।
০৮.০৪.২০২৫ সকাল ৮ টায় বাসার ছয়তলার ছাদ থেকে লাফ দিয়েছে আনিকা। অনেক মানুষজন জড়ো হয়েছে দ্রুত ধরাধরি করে তাকে হাসপাতালের দিকে নিয়ে যাওয়া হচ্ছে। তবে আনিকা এখনো জীবিত কিন্তু তার নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসছে সবাই তাকে বাঁচানোর জন্য আকুল চেষ্টা করছে। কিন্তু সে জানে সে কিছুক্ষণের মধ্যেই মারা যাবে। সে আর বাঁচতে চায় না।
সকাল সকাল রফিক ঘুম থেকে উঠেই বাসার দিকে রওনা দিয়েছে৷ জুতা জোড়া একটি পলিথিনে মুড়িয়ে সে হাতে নিয়ে বের হয়েছে। একবার ইচ্ছে হলো জুতো জোড়া ডাস্টবিনে ছুড়ে ফেলে দিতে। এই জুতোর জন্যই কাণ্ড হয়ে গেল। তারপরও কি মনে করে সে জুতো জোড়া ফেলে দিল না।
বাসার সামনে আসতেই দেখলো প্রচন্ড মানুষের ভিড় সে ভিড় ঠেলে দৌড়ে ভিতরে যেতেই দেখল আনিকাকে অ্যাম্বুলেন্সে তোলা হচ্ছে । আনিকা ছাদ থেকে লাফ দিয়েছে।
রত্না চিৎকার করে বলল কোথায় ছিলে সারারাত? রফিক কোন কথা না বলে রত্না আর আনিকা কে নিয়ে অ্যাম্বুলেন্সে উঠলো দ্রুত এম্বুলেন্সের দরজা লাগিয়ে হাসপাতালের দিকে রওনা হল।
সে এক হাতে তার মেয়ে আনিকাকে ধরে রেখেছে আরেক হাতে পলিথিনে মোড়ানো জুতো জোড়া।
-রত্না রফিক কে বারবার জিজ্ঞেস করছে কোথায় ছিলে কি করেছো যা দেখছি তা সত্য কিনা বল?
-রফিক রত্নার দিকে জুতা জোড়া বের করে দিয়ে বলল জুতা চুরি করেছি? একজন মুসলমান হয়ে আর একজন মুসলমান ভাইয়ের জীবন রক্ষার দাবির আন্দোলনে লুট করেছি। একজন ব্যর্থ বাবা মেয়েকে জুতো কিনে দিবো বলেছিলাম সে জুতো চুরি করে এনেছি! একজন বাঙালি হিসেবে জাতিকে লজ্জিত করেছি।
ততক্ষণে সাইরেন বাঁচাতে বাজাতে অ্যাম্বুলেন্স হাসপাতালের দিকে ছুটে চলল…