সম্প্রতি পরমাণু ইস্যুতে ইরানের সঙ্গে দফায় দফায় আলোচনা করে আসছিল যুক্তরাষ্ট্র। মার্কিন প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্প বরাবরই হুঁশিয়ারি দিয়ে বলে আসছিলেন কোনোভাবেই পরমাণু অস্ত্র সমৃদ্ধ দেশ হিসেবে ইরানকে প্রতিষ্ঠিত হতে দেয়া যাবে না।
তবে ইরান আলোচনায় বসায় এবং নিষেধাজ্ঞা প্রত্যাহারের মতো শর্তসাপেক্ষে ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ শীথিলের আলোচনায় ইতিবাচক ইঙ্গিত দেয়ায় ট্রাম্প সরাসরি ইরানে হামলার ঘোষণা দেননি।
তবে তেহরানের সঙ্গে যুক্তরাষ্ট্রের আলোচনা চললেও কোনোভাবেই ইরানকে পারমাণবিক শক্তিধর দেশ হিসেবে গড়ে ওঠতে দিবে না বলে হুঁশিয়ারি দিয়ে আসছিল চির শত্রু ইসরায়েল। প্রয়োজনে যে কোনো মুহূর্তে ইরানের অভ্যন্তরে হামলারও হুমকি দিয়ে আসছিল তেল আবিব।
এরই ধারাবাহিকতায় শুক্রবার (১৩ জুন) ভোরে পারমাণবিক ও সামরিক স্থাপনাসহ শতাধিক স্থানে ২০০ যুদ্ধবিমান ব্যবহার করে বিমান হামলা চালায় দখলদাররা। তবে তেহরানের পরমাণু গবেষণা কার্যক্রমের বিরুদ্ধে ইসরায়েলের অভিযান নতুন নয়। এর আগে বিভিন্ন সময়ে ইরানে অভিযান পরিচালনা করেছে ইসরায়েলের সশস্ত্র ও গোয়েন্দা বাহিনী। তবে শুক্রবারের অভিযান ছিল দেশদুটির অতীতের সব সংঘাতের চেয়ে ভয়াবহ।
ফলে ২০২৩ সালে গাজায় যুদ্ধ শুরু হওয়ার পর থেকে দুই দেশের মধ্যে সংঘাতময় পরিস্থিতি শুক্রবারের হামলার মধ্য দিয়ে সর্বাত্মক যুদ্ধের আশঙ্কা বাড়িয়ে তুলেছে। আঞ্চলিক আধিপত্য এবং ধর্মীয় দৃষ্টিকোণ থেকে দেশদুটির শত্রুতার ইতিহাস কয়েক দশক ধরে অনেকটাই গোপন সংঘাতের মধ্যে থাকলেও এবার তা রূপ নিয়েছে ভয়াবহ প্রকাশ্য যুদ্ধের দাঁড়প্রান্তে।
ইরান-ইসরায়েলের মধ্যকার সংঘাতময় পরিস্থিতির গুরুত্বপূর্ণ ঘটনাগুলোর সময়রেখা তুলে ধরা হয়েছে রয়টার্সের একটি প্রতিবেদনে—
১৯৭৯: ইসরায়েলকে মিত্র হিসেবে বিবেচনা করতেন ইরানের পশ্চিমাপন্থী নেতা মোহাম্মদ রেজা শাহ। কিন্তু ১৯৭৯ সালে একটি ইসলামী বিপ্লবের মাধ্যমে ক্ষমতা থেকে সরানো হয় তাকে। এর মধ্য দিয়ে ইসরায়েলের বিরোধিতা একটি আদর্শিক বাধ্যবাধকতায় রূপ নেয়। পাশাপাশি একটি নতুন শিয়া ধর্মতান্ত্রিক শাসনব্যবস্থা প্রতিষ্ঠা হয় ইরানজুড়ে।
১৯৮২: ইসরায়েল লেবাননে আক্রমণ করার সাথে সাথে ইরানের বিপ্লবী সরকার ও সামরিক বাহিনী হিজবুল্লাহ প্রতিষ্ঠার জন্য সেখানকার সহযোগী শিয়া মুসলিমদের সাথে কাজ শুরু করে। পরে আধাসামরিক গোষ্ঠীটিকে সীমান্তে তার সবচেয়ে বিপজ্জনক প্রতিপক্ষ হিসেবে দেখা শুরু করে ইসরায়েতেল আবিব।
১৯৮৩: ইরান-সমর্থিত হিজবুল্লাহ লেবানন থেকে পশ্চিমা ও ইসরায়েলি বাহিনীকে বিতাড়িত করার জন্য আত্মঘাতী বোমা হামলা চালায়। নভেম্বরে বিস্ফোরক ভর্তি একটি গাড়ি লেবাননে ইসরায়েলি সামরিক বাহিনীর সদর দপ্তরে ঢুকে পড়ে। পরে ইসরায়েল লেবাননের বেশিরভাগ এলাকা থেকে সরে যায়।
১৯৯২-৯৪: আর্জেন্টিনা এবং ইসরায়েল ১৯৯২ সালে বুয়েনস আইরেসে ইসরায়েলি দূতাবাস এবং ১৯৯৪ সালে শহরের একটি ইহুদি কেন্দ্রে আত্মঘাতী বোমা হামলার পরিকল্পনার জন্য ইরান ও হিজবুল্লাহকে দায়ী করে, যার প্রতিটিতে নিহত হয় কয়েক ডজন মানুষ। তবে ইরান এবং হিজবুল্লাহ এই দায় অস্বীকার করে।
২০০২: ইরানের ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধ করার গোপন কর্মসূচি রয়েছে এমন তথ্য প্রকাশ্যে আসলে উদ্বেগ জাগিয়ে তোলে ইসরায়েল-যুক্তরাষ্ট্র ও পশ্চিমা দেশগুলোর মাঝে। সেসময় অভিযোগ ছিল পরমাণু অস্ত্র বিস্তার রোধ চুক্তির প্রতিশ্রুতি লঙ্ঘন করে পারমাণবিক বোমা তৈরির চেষ্টা করছে তেহরান। তবে দেশটি এমন অভিযোগ অস্বীকার করে। ওই বছর ইসরায়েল ইসলামী প্রজাতন্ত্রের বিরুদ্ধে কঠোর ব্যবস্থা নেওয়ার আহ্বান জানায়।
২০০৬: লেবাননে এক মাসব্যাপী যুদ্ধে ইসরায়েল হিজবুল্লাহর বিরুদ্ধে লড়াই করে কিন্তু ভারী সশস্ত্র গোষ্ঠীটিকে দমন করতে অক্ষম হয়।
২০০৯: এক ভাষণে ইরানের সর্বোচ্চ নেতা আয়াতুল্লাহ আলী খামেনি ইসরায়েলকে "একটি বিপজ্জনক এবং মারাত্মক ক্যান্সার" বলে অভিহিত করেন।
২০১০: বিশ্বাস করা হয় যে যুক্তরাষ্ট্র এবং ইসরায়েল দ্বারা তৈরি হয়েছিল স্টাক্সনেট নামে একটি ক্ষতিকারক কম্পিউটার ভাইরাস। ইরানের নাতানজ ইউরেনিয়াম সমৃদ্ধকরণ পারমাণবিক স্থাপনায় আক্রমণ করার জন্য ব্যবহৃত হয় স্টাক্সনেট। এটি শিল্প যন্ত্রপাতির ওপর প্রথম সর্বজনীন সাইবার আক্রমণ। আর এর মাধ্যমে পারমাণবিক স্থাপনায় ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি সাধনে সক্ষম হয় ইসরায়েল।
২০১২: তেহরানে একজন মোটরসাইকেল আরোহীর গাড়িতে রাখা বোমায় ইরানি পারমাণবিক বিজ্ঞানী মোস্তফা আহমাদি-রোশান নিহত হন। এই হামলার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে তেহরান।
২০১৮: ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহু বহু বছর ধরে চুক্তির বিরুদ্ধে তদবির করার পর বিশ্বশক্তির সাথে ইরানের পারমাণবিক চুক্তি থেকে যুক্তরাষ্ট্রকে প্রত্যাহার করে নেন ডোনাল্ড ট্রাম্প। ট্রাম্পের সিদ্ধান্তকে "একটি ঐতিহাসিক পদক্ষেপ" বলে অভিহিত করেন নেতানিয়াহু।
মে মাসে, ইরানি বাহিনী ইসরায়েল অধিকৃত গোলান হাইটসে রকেট নিক্ষেপ করার পর সিরিয়ায় ইরানি সামরিক অবকাঠামোতে হামলা চালায় তেল আবিব।
২০২০: বাগদাদে আমেরিকান ড্রোন হামলায় ইরানের বিপ্লবী গার্ডের বিদেশি বাহিনীর কমান্ডার জেনারেল কাসেম সোলাইমানি নিহত হয়। এ ঘটনাকে স্বাগত জানায় ইসরায়েল। মার্কিন সেনাদের আবাসস্থল ইরাকি ঘাঁটিতে ক্ষেপণাস্ত্র হামলা চালিয়ে পাল্টা আক্রমণ চালায় ইরান। এতে আহত হয় প্রায় ১০০ মার্কিন সামরিক সদস্য।
২০২১: পারমাণবিক অস্ত্র সক্ষমতা বিকাশের জন্য একটি গোপন ইরানি কর্মসূচির মূল পরিকল্পনাকারী মোহসেন ফখরিজাদেহ হত্যার জন্য ইসরায়েলকে দায়ী করে তেহরান।
২০২২: তৎকালীন মার্কিন প্রেসিডেন্ট জো বাইডেন এবং ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী ইয়ার ল্যাপিড ইরানের পারমাণবিক অস্ত্র প্রত্যাখ্যান করার জন্য বিভক্ত মিত্রদের ঐক্যের মাধ্যমে একটি যৌথ প্রতিশ্রুতিতে স্বাক্ষর করেন।
২০২৪ সালের এপ্রিল: দামেস্কে ইরানি দূতাবাস প্রাঙ্গণে ইসরায়েলি বিমান হামলায় দুই জ্যেষ্ঠ কমান্ডারসহ সাতজন বিপ্লবী গার্ড কর্মকর্তা নিহত হন। এ ঘটনায় ইসরায়েল দায় স্বীকারও করেনি, অস্বীকারও করেনি।
২০২৪ সালের ১৩ এপ্রিল: ইসরায়েলি ভূখণ্ডে এক অভূতপূর্ব সরাসরি আক্রমণে ড্রোন এবং ক্ষেপণাস্ত্র হামলার জবাব দেয় ইরান। এর ফলে ইসরায়েল ১৯ এপ্রিল ইরানের মাটিতে পাল্টা হামলা চালায়।
অক্টোবর ২০২৪: ২৭ সেপ্টেম্বর বৈরুতের দক্ষিণ উপকণ্ঠে বিমান হামলায় হিজবুল্লাহ নেতা হাসান নাসরুল্লাহর হত্যা এবং ৩১ জুলাই ইরানের রাজধানীতে হামাস প্রধান ইসমাইল হানিয়ার হত্যার প্রতিশোধ হিসেবে ইরান ইসরায়েলে ১৮০টিরও বেশি ক্ষেপণাস্ত্র নিক্ষেপ করে।
জুন ১৩, ২০২৫: ইরানে বিমান হামলা চালায় ইসরায়েল। তাদের লক্ষ্য ছিল ইসলামী প্রজাতন্ত্রের পারমাণবিক অবকাঠামো ধ্বংস করা, সামরিক কমান্ডার এবং পারমাণবিক বোমা তৈরিতে কাজ করা বিজ্ঞানীদের হত্যা করা।
এই আক্রমণকে "রাইজিং লায়ন" আখ্যা দিয়ে তেল আবিব বলেছে যে তারা ইরানি কমান্ডার এবং ক্ষেপণাস্ত্র কারখানাগুলোকেও লক্ষ্য করে হামলা চালিয়েছে। ইরানের রাষ্ট্রীয় গণমাধ্যম জানিয়েছে, এই হামলায় তেহরানের বিপ্লবী গার্ড কমান্ডার হোসেইন সালামি, সশস্ত্র বাহিনীর প্রধান মোহাম্মদ বাঘেরি, খতম-আল আনবিয়া সেন্ট্রাল হেডকোয়ার্টারের কমান্ডার ঘোলামালি রশিদসহ ২০ জন সিনিয়র সামরিক কর্মকর্তা নিহত হন। একইসঙ্গে নিহত হয়েছেন ফেরেদুন আব্বাসি-দাভানি এবং মোহাম্মদ মেহেদি তেহরানচিসহ ছয়জন পরমাণুবিজ্ঞানী।
Tags
বিশ্ব সংবাদ