এইচ.এম. সিরাজ, ব্রাহ্মণবাড়িয়া :
ব্রাহ্মণবাড়িয়ায় আইনজীবী দ্বারা বিচারপ্রার্থীর প্রতারিত হবার অভিযোগ মিলেছে। বাদী কর্তৃক নিযুক্তীয় না হয়েও বাদীর স্বাক্ষর জাল করে কাগজ প্রস্তুত, বারংবার আদালতে ভুল ব্যাখ্যা উপস্থাপনে আদেশ বাগিয়ে বাদীকে করেন প্রতারিত, আর্থিক-মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ। তৎবিষয়ে আইনজীবী সমিতিতে অভিযোগেও মিলেনি সুফল। শেষতক দুই আইনজীবীসহ সংশ্লিষ্টদের প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রতিকার পেতে আইনজীবীদের সর্বোচ্চ নিয়ন্ত্রণকারী প্রতিষ্ঠান বাংলাদেশ বার কাউন্সিলে অভিযোগ দাখিল করেছেন।
প্রতারণামূলক পন্থা অবলম্বনে বিচারপ্রার্থীকে হয়রানি, লিখিত অভিযোগের প্রেক্ষিতেও জেলা আইনজীবী সমিতি কর্তৃক ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় দুই আইনজীবী পেশাগত আচারণবিধি লঙ্ঘন করত: বিচারপ্রার্থীকে আর্থিক-মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করেন। ফলে উপায়ান্তর না পেয়ে জেলা শহরের পশ্চিমমেড্ডার মৃত ফেরদৌস আহমেদ ভুইয়ার পুত্র, দুই-দুইটি দেওয়ানী মামলার বিচারপ্রার্থী সৈয়দ আহমেদ জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট জাকারিয়া (সদস্য নং-৪৫৭) এবং অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন আতিক (সদস্য নং ৬৪০) সহ প্রতারক চক্রের প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে দৃষ্টান্ত স্থাপনের দাবীতে ১৪.০৯.২০২৫ খ্রি. তারিখে বাংলাদেশ বার কাউন্সিল সচিব (বাংলাদেশ বার কাউন্সিল ভবন, ৩, শহীদ ক্যাপ্টেন মনসুর আলী সরণী, শাহবাগ, ঢাকা-১০০০) বরাবর লিখিত অভিযোগ দাখিল করেছেন বলে সংশ্লিষ্ট সূত্র নিশ্চিত করেছেন।
লিখিত অভিযোগে উল্লেখ করা হয়, সম্পত্তি সংক্রান্তে ভাই-বোনদের পক্ষে সৈয়দ আহমেদ বাদী হয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সিনিয়র সহকারি জজ (সদর) আদালতে (দে. ৪৭৩/২১ ইং) এবং যুগ্ম জেলা জজ ১ম আদালতে (দে. ৫৫/২০২৩ ইং) মোকদ্দমা দায়ের করেন, যেগুলো বর্তমানে বিচারাধীন। মামলা চলমান অবস্থায় জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাভোকেট জাকারিয়া প্রতারণামূলকভাবে সৈয়দ আহমেদের নিযুক্তীয় আইনজীবী সেজে বাদীর স্বাক্ষর জাল করে কথিত 'সোলেনামা' বানিয়ে ৪৭৩/২১ নং দেওয়ানী মামলার অনুকূলে সদর সিনিয়র সহকারি জজ আদালতে দাখিল করেন। বাদী বিষয়টি অবহিত হয়ে নিযুক্তীয় আইনজীবীর মাধ্যমে আপত্তি দাখিল করেন। দাখিলকৃত আপত্তি গ্রহনান্তে ১৩.১১.২০২৪ ইং তারিখে পদত্ত আদেশে আদালত 'কথিত সোলেনামা' বাতিল করেন। পরবর্তীতে অ্যাভোকেট জাকারিয়া ফের বাদীর স্বাক্ষর জাল করে একই মামলার অনুকূলে একই আদালতে একটি 'আরজি সংশোধনী দরখাস্ত' দাখিল করে মঞ্জুর করান। এটিও অবহিত হয়ে বাদীর দাখিলকৃত আপত্তি'র প্রেক্ষিতে ১৭.০৬.২৫ তারিখে আদালত প্রতারণামূলক আরজি সংশোধনী দরখাস্তটি না-মঞ্জুর করেন।
এদিকে বারংবার একই পন্থায় হয়রানির প্রেক্ষিতে বিচারপ্রার্থী সৈয়দ আহমেদ জেলা আইনজীবী সমিতির স্মরণাপন্ন হন। সমিতির অধিনস্ত সদস্য অ্যাভোকেট জাকারিয়ার বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণে সমিতির সভাপতি ও সাধারণ সম্পাদক বরাবর ০৮.০৫.২০২৫ খ্রি. তারিখে লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। লিখিত অভিযোগটি গ্রহণান্তে 'বিষয়টি নিষ্পত্তিতে বিজ্ঞ যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. ফরহাদ হোসেনকে দায়িত্ব দেয়া হইলো' মন্তব্য উল্লেখে সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. মফিজুর রহমান (বাবুল) সীলমোহরযুক্ত স্বাক্ষর প্রদান করেন। কিন্তু দীর্ঘ সময়েও আইনজীবী সমিতি কর্তৃক কোনো ব্যবস্থা গৃহিত হয়নি।
অপরদিকে পরপর দু'বার হীন উদ্দেশ্য হাসিলে ব্যর্থ হয়ে অ্যাডভোকেট জাকারিয়া এবার তারই আরেক দোসরকে সম্পৃক্ত করে ভিন্ন পন্থা অবলম্বন করেন। তদীয় ভায়েস্টকৃত অ্যাভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন (আতিক) ১৪.০৭.২৫ তারিখ একই আদালতে একই মামলার নথি পুট-আপের মাধ্যমে ইতোপূর্বে না-মঞ্জুরকৃত 'প্রতারণামূলক আরজি সংশোধনী দরখাস্ত' পুনরায় শুনানী করে আদালতে ভুল ব্যাখ্যা উপস্থাপন করে দরখাস্তটি মঞ্জুর করত: মোকদ্দমার তফছিলে বর্ণিত মূলদাগ কর্তনের মাধ্যমে বাদীকে অপূরণীয় ক্ষতির সম্মুখিন করেন। বিষয়টি অবহিত হয়ে মামলার বাদী নিযুক্তীয় আইনজীবীর মাধ্যমে তৎবিষয়ে আপত্তি দাখিল করেন। তৎপ্রেক্ষিতে আদালত ২১.০৭.২৫ তারিখে আপত্তি গ্রহণান্তে সংশোধনী দরখাস্ত বাতিলসহ ০৪.০৭.২৫ তারিখের আদেশটি বাতিল ঘোষণাক্রমে আদেশ প্রদান করেন। পাশাপাশি অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন আতিককে কারণ দর্শানোর নোটিশ প্রদান করা হয় বলেও আদালত সূত্র নিশ্চিত করেছেন।
বারংবার হয়রানির শিকার হওয়া বিচারপ্রার্থী সৈয়দ আহমেদ জেলা আইনজীবী সমিতি বরাবর লিখিত অভিযোগ দাখিলের দীর্ঘ সময়েও সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষ কোনো ব্যবস্থা গ্রহণ না করায় এবং উল্লেখিত আইনজীবীগণ পেশাগত আচারণবিধি লঙ্ঘন করত: বিচারপ্রার্থীকে আর্থিক-মানসিকভাবে ক্ষতিগ্রস্থ করেই চলেছেন। তৎপ্রেক্ষিতে বিচারপ্রার্থী সৈয়দ আহমেদ উপায়ন্তর না পেয়ে ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সদস্য অ্যাডভোকেট জাকারিয়া এবং অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন (আতিক) সহ প্রতারক চক্রের প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডের বিরুদ্ধে প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণের মাধ্যমে দৃষ্টান্ত স্থাপনের দাবীতে প্রয়োজনীয় তথ্য-প্রমাণাদি সংযুক্ত করত: বাংলাদেশ বার কাউন্সিল সচিব বরাবর লিখিত অভিযোগ দাখিল করেন। বার কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ ১৪.০৯.২০২৫ তারিখে লিখিত অভিযোগটি আনুষ্ঠানিকভাবে গ্রহণ করত: অভিযোগকারীকে সীলমোহরকৃত ছায়াকপি প্রদান করেন।
অভিযুক্ত অ্যাডভোকেট মোয়াজ্জেম হোসেন (আতিক) বলেন, 'আমার বিরুদ্বে অভিযোগ দেয়ার বিষয়টি আমার জানা নেই। তাছাড়া ওই মামলার ড্রাফ্টিং আমার নয়, বাদী তার আরজি অন্যত্র থেকে ড্রাফ্ট করে আমার কাছে আনার পর আমি ফাইলিং ল'ইয়ার হিসেবে স্বাক্ষর করে আদালতে মামলাটি দাখিল করি। কিন্তু পরবর্তীতে বাদী মামলাটি আমার কাছ থেকে নিয়ে অন্য কাউকে দিয়ে পরিচালনা করাচ্ছেন। সুতরাং এই মামলার বিষয়ে আমার আর কোনো ইন্টারেস্ট নেই বিধায় কিছুই বলারও নেই।'
অভিযুক্ত অ্যাডভোকেট জাকারিয়া বলেন, 'আইনজীবী সমিতি এবং বার কাউন্সিলে আমার বিরুদ্ধে অভিযোগ দাখিলের বিষয়টি শুনে আমি রীতিমতো হতবাক হয়েছি। কেননা এসবের সাথে আমার কোনোই সম্পৃক্ততা নাই। মামলার বাদীকে আমি চিনিও না। সবচে' বড় কথা, আমি দেওয়ানী আদালতে এযাবৎ কোনো মামলা চালাইনি; আমার সকল কাজকর্ম ফৌজদারি আদালতে। যেহেতু বাদীর স্বাক্ষর জাল করে সোলেনামা দাখিলের বিষয় দিয়ে শুরু, তাহলে আমার স্বাক্ষরও হয়তো জাল করেছে! এসব দালাল চক্রের অপকর্ম হতে পারে। আমি কেন, কোনো আইনজীবীই এরকম প্রতারণামূলক কর্মকাণ্ডে জড়াবে বলে আমার ধারণার বাইরে।'
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সাধারণ সম্পাদক অ্যাডভোকেট মো. মফিজুর রহমান (বাবুল) অভিযোগ প্রাপ্তির সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন, 'বিষয়টি খতিয়ে দেখতে সমিতির যুগ্ম সাধারণ সম্পাদককে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে, আপডেট জেনে সিদ্ধান্ত নেবো। তাছাড়া যেহেতু ওই মামলার বাদী বার কাউন্সিলে অভিযোগ দাখিল করেছেন, সেহেতু বার কাউন্সিল বিষয়টি আমলে নিয়ে আমাদেরকেও অবহিত করেই প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা নিবেন এবং সেই সিদ্ধান্তের বাইরে মন্তব্যের সুযোগ নেই।'
ব্রাহ্মণবাড়িয়া জেলা আইনজীবী সমিতির সভাপতি অ্যাডভোকেট এ.কে.এম. কামরুজ্জামান মামুন বিষয়ের সত্যতা নিশ্চিত করে বলেন,'বিচারপ্রার্থী যেহেতু বার কাউন্সিলে লিখিত অভিযোগ করেছেন, বার কাউন্সিল কর্তৃপক্ষ তদন্তপূর্বক উপযুক্ত ব্যবস্থা গ্রহণ করবেন এবং আমরাও তৎবিষয়টি সম্মানের সাথে মেনে নেবো। কারণ বাংলাদেশ বার কাউন্সিল আমাদের অনন্য নিয়ন্ত্রণকারী তথা অভিভাবক প্রতিষ্ঠান। তাছাড়া কেউ অন্যায় করে থাকলে তাকেই দায়ভার বহন করতে হবে, এক্ষেত্রে আমাদের কোনো পক্ষপাতিত্ব নাই। কেননা, অন্যায় সর্বদায়ই অন্যায়।'