সুলতান আল এনাম, ঝিনাইদহ প্রতিনিধি : ত্রয়োদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনের তফসিল ঘোষিত হয়েছে। আওয়ামী লীগবিহীন জাতীয় সংসদ নির্বাচনে দেশের দক্ষিণ-পশ্চিমাঞ্চলের সীমান্ত ঘেষা জেলা ঝিনাইদহে বড় দল জামায়াতের নেতাকর্মীরা ফুরফুরে মেজাজে থাকলেও শঙ্কায় রয়েছে বর্তমান প্রধান বৃহৎ দল বিএনপির নেতা-কর্মীদের মনে। জেলার ৪টি নির্বাচনী আসনে জামায়াত ইসলামী, এবি পার্টি ও ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশের প্রার্থী ঘোষিত হলেও মাত্র একটি আসনে দলীয় প্রার্থী ঘোষণা করেছে বিএনপি। বাকী ৩টি আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশীদের কর্মী ও সমর্থকদের মধ্যে রয়েছে ব্যাপক উৎকণ্ঠা ও হতাশা। কাজেই তফসিল ঘোষিত হলেও আনন্দের উত্তাপ নেই তাদের মনে।
নির্বাচর অফিসের তথ্যানুযায়ী ঝিনাইদহ জেলায় ৪টি নির্বাচনী আসনে ১৫ লাখ ৮৬ হাজার ৬৭৮ জন ভোটার। শৈলকুপা উপজেলা নিয়ে ঝিনাইদহ-১ সংসদীয় আসন। এই আসনে ১১৭টি ভোট কেন্দ্রে ভোটার রয়েছেন ৩ লাখ ২১ হাজার ৬০৪জন। সদর উপজেলার আংশিক ও হরিণাকুণ্ডু নিয়ে ঝিনাইদহ-২ আসন। এই আসনে ১৯৪টি ভোট কেন্দ্রে ভোটার রয়েছেন ৪ লাখ ৯৬ হাজার ১০৯ জন। কোটচাঁদপুর ও মহেশপুর উপজেলা নিয়ে ঝিনাইদহ-৩ আসন। এই আসনে ১৬৬টি ভোট কেন্দ্রে ভোটার রয়েছেন ৪ লাখ ২৪ হাজার ৯৫৮ জন। ঝিনাইদহ সদর উপজেলার ৩টি ইউনিয়ন ও কালীগঞ্জ উপজেলা নিয়ে ঝিনাইদহ-৪ আসন। এই আসনে ১২১টি ভোট কেন্দ্রে ভোটার রয়েছেন ৩ লাখ ৪৪ হাজার ৭জন। জেলায় মোট পুরুষ ভোটারের সংখ্যা ৭ লাখ ৯৫ হাজার ৩৪৭টি এবং নারী ভোটারের সংখ্যা ৭ লাখ ৯১ হাজার ৩১৪টি।
ঝিনাইদহের ৪টি সংসদীয় আসনের মধ্যে বাংলাদেশ জামায়াত ইসলামী, ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ, এবি পার্টি আসন ভিত্তিক দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছেন। কিন্তু বিএনপি শুধু মাত্র ঝিনাইদহ-৩ আসনে দলীয় প্রার্থীর নাম ঘোষণা করেছে। তাতে বাকী ৩টি আসনে মনোনয়ন প্রত্যাশী প্রার্থীদের কর্মী-সমর্থকরা রয়েছেন উৎকণ্ঠায়।
ঝিনাইদহ-১ আসনে জামায়াত ইসলামীর প্রার্থী উপজেলা আমীর মাওলানা এএসএম মতিউর রহমান। তিনি দলীয় সকল ইউনিটের নেতাকর্মীদের নিয়ে নিয়মিত প্রচারণায় রয়েছেন। এই আসনে ইসলামী আন্দোলনের প্রার্থী হয়েছেন জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নজরুল ইসলাম দুলাল বিশ্বাসের ভাই ও জেলা মৎস্যজীবী লীগের সাবেক আহ্বায়ক নুর আলম বিশ্বাস। তিনি ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশে যোগ দিয়ে মনোনয়ন বাগীয়ে নিয়েছেন। তার বড় ভাই নজরুল ইসলাম দুলাল দ্বাদশ জাতীয় সংসদ নির্বাচনে ঝিনাইদহ-১ আসনে জেলা আওয়ামী লীগের সভাপতি বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত আব্দুল হাই’য়ের বিরুদ্ধে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে লড়েছিলেন। এই আসনে এবি পার্টির মনোনয়ন পেয়েছেন মতিয়ার রহমান। এই আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী অ্যাটর্নী জেনারেল মোঃ আসাদুজ্জামান, বিএনপির খুলনা বিভাগীয় সহ সাংগঠনিক সম্পাদক জয়ন্ত কুমার কুণ্ডু ও জাতীয়তাবাদী কৃষক দলের খুলনা বিভাগী সাংগঠনিক সম্পাদক ও জেলা আহ্বায়ক ওসমান আলী। অ্যাটর্নী জেনারেল মোঃ আসাদুজ্জামান দলীয় মনোনয়ন পেলে রাষ্ট্রীয় দায়িত্ব থেকে পদত্যাগ করে নির্বাচন করে পদত্যাগ করবেন বলে ঘোষণা দিয়েছেন। নির্বাচনে ভোটারদের আকৃষ্ট করতে এই নির্বাচনী এলাকায় তিনি বেশি সার-বীজের বরাদ্দ, রাস্তা-ঘাট নির্মাণের অনুমোদন এনে দিয়েছেন। সহিংসতাপ্রবণ শৈলকুপা অঞ্চলে নেতাকর্মীদের দাঙ্গা ও সংঘর্ষে জড়াতে দেননি এই কারণে তিনি প্রতিদ্বন্দ্বি মনোনয়ন প্রত্যাশীদের কাছ থেকে আওয়ামী লীগের নেতাকর্মীদের লালন-পালনের অভিযোগও গায়ে জড়িয়েছেন। অপরদিকে জয়ন্ত কুমার কুণ্ডুর পক্ষে উপজেলা বিএনপির একটি বড় অংশ রয়েছে। তারা দাবি করছেন জয়ন্ত কুমার কুণ্ডু মনোনয়ন পেলে আসনটি বিএনপির হাতে থাকবে। আসাদুজ্জামান ও জয়ন্ত কুমার কুন্ডুর মধ্যে এই আসনে বিএনপির মনোনয়ন যুদ্ধ চলছে। তবে জামায়াতের প্রার্থীর দাবি অতীতের সব রেকর্ড ভেঙে দিয়ে এবার জামায়াত এই আসনে খেলা দেখাবে।
ঝিনাইদহ-২ আসনটি জেলার সব থেকে গুরুত্বপূর্ণ। এই আসনের মধ্যেই রয়েছে জেলা শহর। এই আসনে দুইবার আওয়ামী লীগের ডাকসাইটে নেতা নূর-ই-আলম সিদ্দিকীকে পরাজিত করে এমপি নির্বাচিত হয়েছেন। বিএনপির ঘাটি হিসেবে পরিচিত এই আসনটি। এই আসনে জামায়াত ইসলামীর প্রার্থী মনোনীত হয়েছেন জেলা আমীর আলী আজম মুহাম্মদ আবু বকর। ২০২৪ সালের ৫ আগস্টের আগে তিনি জামায়াত ইসলামীর নেতা এমন পরিচিতিই মাঠে ছিলনা। আওয়ামী লীগ সরকার পতনের পর জেলা জামায়াতের আমীর হিসেবে তাকে মানুষ চিনেছে। বিএনপি থেকে অনেকেই এই আসনে মনোনয়ন চাইলেও বর্তমানে জেলা বিএনপির সভাপতি এম এ মজিদ ও সাবেক এমপি বীর মুক্তিযোদ্ধা প্রয়াত মশিউর রহমানের ছেলে ডাঃ ইব্রাহীম রহমান বাবু প্রার্থী হিসেবে মাঠে আছেন। যদীয় এক সপ্তাহের অধিক প্রচারণার মাঠে দেখা যায়নি বাবুকে। বিএনপির সকল ইউনিটের নেতাকর্মীদের সাথে নিয়ে প্রতিদিন মাঠ চষে বেড়াচ্ছেন এম এ মজিদ। রাজনৈতিক সচেতন মহল বলছে তিনিই এই আসনে জনপ্রিয় প্রার্থী। এই আসনে গণ অধিকার পরিষদের কেন্দ্রীয় সাধারণ সম্পাদক মোঃ রাশেদ খান দলীয় মনোনয়ন পেয়েছেন। ইসলামী আন্দোলন বাংলাদেশ থেকে জেলা সভাপতি এইচএম মোমতাজুল করিম এই আসনে হাতপাখার মনোনয়ন পেয়েছেন। এবি পার্টি থেকে হাদীউজ্জামান খোকনকে মনোনয়ন দেওয়া হয়েছে।
সাবেক এমপি ও জেলা আওয়ামী লীগের সহসভাপতি নাসের শাহরিয়ার জাহেদী মহুল এই আসনে স্বতন্ত্র নির্বাচন করতে পারেন বলেও তার মুখপাত্র তবিবুর রহমান লাবু জানিয়েছেন। তার নির্বাচনে অংশগ্রহণকে প্রতিহত করার ঘোষণা দিয়েছে গণঅধিকার পরিষদ ও শিবিরের নেতাকর্মীরা।
এদিকে, জেলায় কানাঘুষা চলছে ঝিনাইদহ-২ আসনটি জোটের প্রার্থীর জন্য ছেড়ে দেওয়া হতে পারে। বিএনপির সাথে গণঅধিকার পরিষদের জোট হলে মোঃ রাশেদ খান জোটের প্রার্থী হতে পারেন এমনটি শোনা যাচ্ছে। তবে ক্রীড়া উপদেষ্টা পদত্যাগ করে গণঅধিকার পরিষদে যোগ দিচ্ছেন এমন সংবাদে রাশেদ খানের জোট প্রার্থীতা সংশয়ের খবর প্রচার হতে দেখা যাচ্ছে। তবে রাশেদ খান প্রতিনিয়ত নেতাকর্মীদের নিয়ে আসনটিতে নির্বাচনী প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছেন।
রাশেদ খান বলেন, ২০২২ সাল থেকে আমরা(গণঅধিকার পরিষদ) বিএনপির সাথে যুগপৎ আন্দোলন করছি। শেখ হাসিনার সরকার পতনের আন্দোলও একসাথে করেছি। আমরা একসাথে ভোট করতে পারি কিনা সেব্যাপারে আলোচনা চলছে। আজ(শনিবার) দুপুরে একটা আলোচনা সভা এ ব্যাপারে অনুষ্ঠিত হবে। তার পরেই নিশ্চিতভাবে বলা সম্ভব হবে আমি এই আসনে জোটের প্রার্থী হচ্ছি কিনা। আর সদ্য সাবেক উপদেষ্টা আসিফ মাহমুদ সজীব ভুইয়া গতকাল(শুক্রবার) সকালে ঘোষণা দিয়েছেন তিনি ঢাকার আসনে স্বতন্ত্র নির্বাচন করবেন। তিনি অতীতে গণঅধিকার পরিষদের সাথে ছিলেন। তিনি চাইলে গণঅধিকার পরিষদের রাজনীতিতে আসতে পারেন তার জন্য এই পথ খোলা রয়েছে।
জেলা বিএনপির সাধারণ সম্পাদক জাহিদুজ্জামান মনা বলেন, বিএনপি সবচেয়ে বড় দল। দলের মধ্যে অনেক নেতাকর্মী রয়েছেন বিভিন্ন মত থাকবে এটাই স্বাভাবিক। তবে বর্তমানে ঝিনাইদহ-২ আসনে বিএনপির একক প্রার্থী জেলা বিএনপির সভাপতি এম এ মজিদ। দলের সব ইউনিট তার নেতৃত্বে প্রতিনিয়ত ধানে শীষের পক্ষে প্রচারণা চালিয়ে যাচ্ছে। ঝিনাইদহ শহর জেলার রাজনীতিতে সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ জায়গা। এখানে বিএনপি নিয়ন্ত্রণ হারালে রাজনীতি হযবরল হয়ে যাবে। সেই কারণে আমরা মনে করি কেন্দ্রীয় নেতৃবৃন্দ অবশ্যই এই দিকটা দেখবেন। বিএনপি থেকে এমএ মজিদকে মনোনয়ন দিলে এই আসনে বিএনপির বিজয় অনেকটা নিশ্চিৎ।
জেলা জামায়াতের আমীর আলী আজম মুহাম্মদ আবু বকর বলেন, ৪টি আসনেই আমরা বিজয় অর্জন করবো বলে আশাবাদী। আমরা প্রতিনিয়ত ভোটের প্রচারণা চালাচ্ছি। ভোটারদের প্রচুর সাড়া পাচ্ছি।
জেলা বিএনপির দপ্তর সম্পাদক সাকিব আহমেদ বাপ্পি বলেন, ঝিনাইদহ-২ আসন যদি শরিক দলকে বা জোটের প্রার্থীর জন্য ছেড়ে দেওয়া হয় তাহলে এই আসনটি জামায়াতের দখলে চলে যাবে। ১৯৯১ সাল থেকে এই আসন বিএনপির ঘাটি হিসেবে পরিচিত। শরিক দলের জন্য এই আসন ছাড়লে তার বিরুপ প্রভাব জেলার অন্য আসনগুলিতেও পড়বে। বিএনপির নেতাকর্মীরা ৩টি সংসদ নির্বাচনে ভোট দিতে পারেনি। তারা ধানের শীষে ভোট দেওয়ার জন্য মুখিয়ে আছে। সঠিক দলীয় প্রার্থী নির্বাচিত হলে জেলায় সর্বত্র বিএনপির বিজয় হবে।
ঝিনাইদহ-৩ আসনে বিএনপির মনোনয়ন পেয়েছেন সাবেক এমপি প্রয়াত সহিদুল ইসলাম মাস্টারের ছেলে তরুণ রাজনীতিবিদ মেহেদী হাসান রনিকে। এই আসনে জামায়াত ইসলামীর মনোনয়ন পেয়েছেন কেন্দ্রীয় নেতা মাওলানা মতিউর রহমান। এই আসনে এবি পার্টির মনোনয়ন পেয়েছেন মুফতি মুজাহিদুল ইসলাম। অন্যদলগুলি এই আসনে প্রার্থী দিতে পারেনি। তবে এই আসনে বিএনপির মনোনয়ন চেয়েছিলেন কেন্দ্রীয় নেতা আমিরুজ্জামান খান শিমুল, সাবেক জাসাস নেতা ও কণ্ঠশিল্পি মনির খান ও সুপ্রিম কোর্টের আইনজীবী অ্যাডঃ রুহুল কুদ্দুস কাজল তাদের ছাপিয়ে মনোনয়ন জিতে নিয়েছেন মেহেদী হাসান রনি।
ঝিনাইদহ-৪ আসনে জামায়াতের মনোনয়ন পেয়েছেন উপজেলা আমীর মাওলানা আবু তালেব। এই আসনে গণঅধিকার পরিষদের মনোনয়ন পেয়েছেন জেলা সভাপতি প্রভাষক সাখাওয়াত হোসেন এবং ইসলামী আন্দোলনের মনোনয়ন পেয়েছেন উপজেলা সভাপতি মুফতি আব্দুল জলিল। এই আসনে বিএনপির মনোনয়ন প্রত্যাশী কেন্দ্রীয় স্বেচ্ছাসেবক দলের যুগ্ম সাধারণ সম্পাদক সাইফুল ইসলাম ফিরোজ, উপজেলা বিএনপির যুগ্ম আহ্বায়ক হামিদুল ইসলাম হামিদ ও সাবেক এমপি প্রয়াত শহিদুজ্জামান বেল্টুর স্ত্রী মুর্শেদা জামান। ৫ আগস্টের পরে দলীয় আধিপত্য বিস্তারের দ্বন্দ্বে এই আসনে কয়েকজন বিএনপি নেতাকর্মী হত্যার শিকার হয়েছেন। দলীয় কর্মসূচি আলাদা আলাদা ভাবে পালন করে এই আসনে নিজেদের অস্তিত্ব জানান দিয়েছেন সাইফুল ইসলাম ফিরোজ ও হামিদুল ইসলাম হামিদ। তাদের মধ্যে প্রচন্ড আকারে চলছে মনোনয়ন যুদ্ধ।
রাজনীতি বিশ্লেষকরা বলছেন ঝিনাইদহ-১ আসনে ভালো প্রার্থী মনোনীত করতে পারলে আসনটি বিএনপির দখলে থাকবে। ঝিনাইদহ-২ আসনে বিএনপি যদি শরিক দলের জন্য আসনটি ছেড়ে দেন তাহলে তারা জেলার রাজনীতির নিয়ন্ত্রণ হারাবে। জামায়াত ইসলামীর প্রার্থী সেই ক্ষেত্রে এই আসনে জয়ী হওয়ার সম্ভাবনা বেড়ে যাবে। ঝিনাইদহ-৩ আসনে জামায়াতের প্রার্থী মাওলানা মতিউর রহমান ব্যাপক জনপ্রিয়। তার তুলনায় এই আসনে মেহেদী হাসান রনি দুর্বল প্রার্থী। ঝিনাইদহ-৪ আসনে বিএনপির জনপ্রিয় দুই প্রার্থীর মধ্যে তুমুল প্রতিদ্বন্দ্বিতা। তাদের একজন মনোনয়ন পেলে অপর প্রার্থীর সমর্থকরা তার পক্ষে নির্বাচনে কাজ করবে কিনা তা নিয়ে সংশয় রয়েছে। দ্বন্দ্বে জড়ালে জামায়াতের লাভ হবে। তবে ভোটের ফলাফল নির্ভর করছে বিএনপির প্রার্থী নির্বাচনের ওপর।
