মো. সাইদুল ইসলাম :
টাঙ্গাইল জেলার একটি ঐতিহ্যবাহী ও প্রাচীন উপজেলা হলো নাগরপুর। এটি টাঙ্গাইল জেলার দক্ষিণ-পূর্ব প্রান্তে অবস্থিত। এখানে নাগরপুর উপজেলা সম্পর্কে বিস্তারিত তথ্য দেওয়া হলো:
১. পরিচিতি ও নামকরণ: নাগরপুর থানা হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় ১৯০৬ সালে এবং ১৯৮৩ সালের ১০ সেপ্টেম্বর এটি উপজেলায় উন্নীত হয়। নাগরপুরের নামকরণের পেছনে বেশ কয়েকটি লোককাহিনী বা জনশ্রুতি প্রচলিত আছে। এর মধ্যে একটি জনপ্রিয় জনশ্রুতি হলো, একসময় যমুনা-ধলেশ্বরী বেষ্টিত এই অঞ্চলে প্রচুর বনজঙ্গল ছিল এবং বিষধর সাপ (নাগ) বাস করত। পরে পুরী থেকে 'নাগর মিয়া' নামে এক ব্যক্তি তার অনুসারীদের নিয়ে এখানে আসেন এবং তাদের আগমনে এলাকাটি নিরাপদ হয়ে ওঠে। এভাবেই 'নাগ' ও 'পুর' (পূর্ণ হওয়া) শব্দ দুটি থেকে 'নাগরপুর' নামের উৎপত্তি।
২. ভৌগোলিক অবস্থান ও আয়তন: নাগরপুর উপজেলার আয়তন ২৬৬.৭৭ বর্গ কিলোমিটার। এর উত্তরে টাঙ্গাইল সদর উপজেলা ও দেলদুয়ার উপজেলা, দক্ষিণে মানিকগঞ্জ জেলার দৌলতপুর উপজেলা, পূর্বে মির্জাপুর উপজেলা, সাটুরিয়া উপজেলা ও ঢাকা জেলার ধামরাই উপজেলা এবং পশ্চিমে সিরাজগঞ্জ জেলার চৌহালী উপজেলা ও মানিকগঞ্জ জেলার দৌলতপুর উপজেলা অবস্থিত। এই উপজেলায় তিনটি প্রধান নদী প্রবাহিত হয়েছে: ধলেশ্বরী, যমুনা ও নোয়াই।
৩. জনসংখ্যা: ২০১১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী, নাগরপুর উপজেলার মোট জনসংখ্যা ২,৮৮,০৯২ জন (পুরুষ ১,৩৬,৫৮৫ জন, মহিলা ১,৫১,৫০৭ জন)। প্রতি বর্গকিলোমিটারে জনসংখ্যার ঘনত্ব ৯৬৭ জন।
৪. প্রশাসনিক কাঠামো: নাগরপুর উপজেলা ১২টি ইউনিয়ন, ২১৮টি মৌজা এবং ২৪৪টি গ্রাম নিয়ে গঠিত। এটি ১৩৫, টাঙ্গাইল-৬ সংসদীয় আসনের অন্তর্ভুক্ত।
৫. অর্থনীতি: নাগরপুর উপজেলার অর্থনীতির প্রধান উৎস হলো কৃষি। এখানকার জনগোষ্ঠীর প্রায় ৬১.৬৩% কৃষিকাজের সাথে জড়িত। এছাড়া ব্যবসা, পরিবহন, চাকরি এবং রেমিট্যান্সও অর্থনীতির গুরুত্বপূর্ণ অংশ।
৬. শিক্ষা ব্যবস্থা: নাগরপুর উপজেলায় শিক্ষার হার প্রায় ৬৯.৭%। এখানে বেশ কিছু শিক্ষা প্রতিষ্ঠান রয়েছে:
- কলেজ: ৬টি
- মাধ্যমিক বিদ্যালয়: ৪০টি
- নিম্ন মাধ্যমিক বিদ্যালয়: ৪টি
- মাদ্রাসা: ১৯টি (কামিল ১টি, ফাজিল ১টি, আলিম ২টি, দাখিল ১৫টি)
- এবতেদায়ী মাদ্রাসা: ৩৮টি
- কিন্ডারগার্টেন: ৩৪টি
- সরকারি প্রাথমিক বিদ্যালয়: ১৫৬টি
৭. দর্শনীয় স্থান ও ঐতিহ্য: নাগরপুরের ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা এবং দর্শনীয় স্থানগুলোর মধ্যে অন্যতম হলো:
- নাগরপুর চৌধুরী বাড়ি (জমিদার বাড়ি): এটি ঊনবিংশ শতাব্দীতে জমিদার যদুনাথ চৌধুরী কর্তৃক নির্মিত একটি কারুকার্যমণ্ডিত জমিদার বাড়ি। প্রায় ৫৪ একর জায়গার উপর এটি অবস্থিত। এই বাড়ির মূল ভবনে বর্তমানে নাগরপুর মহিলা ডিগ্রি কলেজ স্থাপন করা হয়েছে। এখানে একটি রঙমহল ছিল, যার পাশে বিভিন্ন প্রাণীতে সজ্জিত চিড়িয়াখানা এবং বাড়ীর দক্ষিণ দিকে ১১ একর জায়গার উপর "উপেন্দ্র সরোবর" নামের একটি দীঘি রয়েছে।
- পাকুটিয়া জমিদার বাড়ি: টাঙ্গাইল জেলার নাগরপুর উপজেলায় অবস্থিত এটিও একটি ঐতিহ্যবাহী স্থাপনা।
- মোকনা জমিদার বাড়ি: টাঙ্গাইল জেলার প্রাচীন জমিদার বাড়িগুলোর মধ্যে এটিও অন্যতম।
এছাড়া মামুদনগর এলাকায় সুলতান মাহমুদ শাহ-এর রাজধানী ছিল বলে জনশ্রুতি আছে, যেখানে শেরশাহ-এর জঙ্গল, মতিবিবির বাগ এবং ১০১টি পুকুরের অস্তিত্ব দেখা যায় বলে কথিত আছে।
নাগরপুর একটি শান্ত, সবুজ এবং ঐতিহ্যবাহী উপজেলা যা তার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এবং সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যের জন্য পরিচিত।