![]() |
Karbala, Iraq on July, 2025. Photo Credit : Mustafa AbdulHadi/Daily News BD |
মো. সাইদুল ইসলাম : কারবালা হলো ইরাকের একটি ঐতিহাসিক ও ধর্মীয় গুরুত্বপূর্ণ শহর। এটি ইরাকের রাজধানী বাগদাদ থেকে প্রায় ১০০ কিলোমিটার (৬২ মাইল) দক্ষিণ-পশ্চিমে অবস্থিত এবং কারবালা প্রদেশের রাজধানী।
কারবালার ঐতিহাসিক গুরুত্ব
কারবালা মূলত ঐতিহাসিক কারবালার যুদ্ধের জন্য বিশ্বজুড়ে পরিচিত। ৬১ হিজরি সনের ১০ই মুহাররম (১০ অক্টোবর, ৬৮০ খ্রিস্টাব্দ) তারিখে এই যুদ্ধ সংঘটিত হয়েছিল। এই যুদ্ধে ইসলামের মহানবী হযরত মুহাম্মদ (সা.)-এর দৌহিত্র হযরত হোসাইন ইবনে আলী (রা.) ইয়াজিদের বাহিনীর হাতে শাহাদাতবরণ করেন। তার পরিবার এবং ৭২ জন সঙ্গী-সাথীও এই যুদ্ধে শহীদ হন। এই ঘটনা মুসলিম বিশ্বের, বিশেষ করে শিয়া মুসলমানদের কাছে অত্যন্ত শোকাবহ এবং তাৎপর্যপূর্ণ। শিয়ারা মক্কা, মদিনা ও জেরুজালেমের পর কারবালাকে তাদের চতুর্থ পবিত্রতম স্থান হিসেবে গণ্য করে।
কারবালার নামটি আরবি শব্দ 'কার্ব' (যন্ত্রণা) এবং 'বালা' (দুর্দশা) থেকে এসেছে বলে মনে করা হয়, যা এই স্থানে ঘটে যাওয়া বিয়োগান্তক ঘটনার প্রতীক। ফোরাত নদীর তীরে অবস্থিত এই প্রান্তর মুসলিম ইতিহাসে এক কালো অধ্যায় হিসেবে চিহ্নিত।
![]() |
Karbala, Iraq on July, 2025. Photo Credit : Mustafa AbdulHadi/Daily News BD |
ইরাক এবং কারবালা
ইরাক মধ্যপ্রাচ্যের একটি রাষ্ট্র। এর সরকারি নাম 'রিপাবলিক অফ ইরাক'। ইরাকের দক্ষিণে কুয়েত ও সৌদি আরব, পশ্চিমে জর্ডান, উত্তর-পশ্চিমে সিরিয়া, উত্তরে তুরস্ক এবং পূর্বে ইরান অবস্থিত। এর রাজধানী হলো বাগদাদ।
ইরাকের মোট আয়তন ৪,৩৭,০৭২ বর্গ কিলোমিটার এবং এর প্রধান ভাষা আরবি। ঐতিহাসিকভাবে ইরাক প্রাচীন মেসোপটেমিয়ার অংশ, যা মানব সভ্যতার জন্মভূমি হিসেবে পরিচিত। এই অঞ্চলে সুপ্রাচীন সভ্যতা যেমন সুমেরীয়, আক্কাদীয়, ব্যাবিলনীয় এবং আসিরীয় সভ্যতার বিকাশ ঘটেছিল। মধ্যযুগে ইরাক ইসলামিক সাম্রাজ্যের একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র ছিল।
![]() |
Karbala, Iraq on July, 2025. Photo Credit : Mustafa AbdulHadi/Daily News BD |
কারবালা শহর ইরাকের একটি প্রধান ধর্মীয় কেন্দ্র হিসেবে পরিচিত। এখানে হযরত হোসাইন (রা.) এবং তার ভাই হযরত আব্বাস (রা.)-এর মাজার অবস্থিত। প্রতি বছর লাখ লাখ শিয়া মুসলিম, বিশেষ করে আশুরা এবং আর্বাইন (আশুরার ৪০ দিন পর) উপলক্ষে কারবালায় তীর্থযাত্রার জন্য আসেন। এটি বিশ্বের অন্যতম বৃহৎ শান্তিপূর্ণ জনসমাগমগুলোর মধ্যে একটি।
বর্তমানে কারবালা শহর ধর্মীয় পর্যটনের জন্য একটি গুরুত্বপূর্ণ কেন্দ্র। সাদ্দাম হোসেনের শাসনের অবসানের পর থেকে এই শহরে পর্যটন শিল্পের ব্যাপক প্রসার ঘটেছে। কারবালায় কারবালা ইন্টারন্যাশনাল স্টেডিয়ামসহ আধুনিক ক্রীড়া সুবিধাও রয়েছে।
![]() |
Karbala, Iraq on July, 2025. Photo Credit : Mustafa AbdulHadi/Daily News BD |
কারবালা এবং ইরাকের মধ্যে সম্পর্ক নিবিড়। কারবালা ইরাকের অন্যতম গুরুত্বপূর্ণ একটি শহর যা দেশের ধর্মীয়, ঐতিহাসিক এবং সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে এক বিশেষ স্থান দখল করে আছে।
ইরাকের ইতিহাস অত্যন্ত সমৃদ্ধ এবং দীর্ঘ, যা প্রায় সভ্যতার সূতিকাগার হিসেবে পরিচিত মেসোপটেমিয়া অঞ্চলকে কেন্দ্র করে গড়ে উঠেছে। একে "সভ্যতার দোলনা"ও বলা হয়। নিম্নোক্ত প্রধান পর্যায়ক্রমে ইরাকের ইতিহাস তুলে ধরা হলো:
![]() |
Karbala, Iraq on July, 2025. Photo Credit : Mustafa AbdulHadi/Daily News BD |
প্রাচীন মেসোপটেমিয়া (প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ৬০০০ - ৫৩৯ অব্দ): ইরাকের আধুনিক ভূখণ্ডই প্রাচীন মেসোপটেমিয়া নামে পরিচিত ছিল, যা দজলা (টাইগ্রিস) ও ফোরাত (ইউফ্রেটিস) নদীর মধ্যবর্তী উর্বর উপত্যকায় অবস্থিত। এই অঞ্চলে বিশ্ব ইতিহাসের প্রথম কিছু প্রধান সভ্যতা গড়ে উঠেছিল।
সুমেরীয় সভ্যতা (প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ৪০০০ - ২২৩৪ অব্দ): এটি বিশ্বের প্রথম পরিচিত সভ্যতা, যেখানে নগর-রাষ্ট্র, লিখিত ভাষা (কুনাইফর্ম), গণিত, জ্যোতির্বিদ্যা, আইন এবং সাহিত্যের বিকাশ ঘটেছিল। উর, উরুক, লাগাশ ছিল এই সভ্যতার গুরুত্বপূর্ণ নগরী।
আক্কাদীয় সাম্রাজ্য (প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ২২৩৪ - ২১৮০ অব্দ): সুমেরীয়দের পর আক্কাদীয়রা এই অঞ্চলে আধিপত্য বিস্তার করে এবং প্রথম বৃহৎ সাম্রাজ্য প্রতিষ্ঠা করে। সারগন দ্য গ্রেট ছিলেন এই সাম্রাজ্যের একজন বিখ্যাত শাসক।
ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য (প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ১৮৯৪ - ৫৩৯ অব্দ): প্রাচীন ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য হাম্মুরাবির বিখ্যাত আইন সংহিতার জন্য পরিচিত। পরে নব্য-ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্য (খ্রিস্টপূর্ব ৬২৬ - ৫৩৯ অব্দ) নেবুচাদনেজার দ্বিতীয়ের অধীনে ব্যাবিলনকে একটি বিশাল ও সমৃদ্ধশালী শহরে পরিণত করে।
আসিরীয় সাম্রাজ্য (প্রায় খ্রিস্টপূর্ব ৯১১ - ৬১২ অব্দ): আসিরীয়রা ছিল শক্তিশালী যোদ্ধা জাতি, যারা একটি বিশাল সাম্রাজ্য গড়ে তুলেছিল। তাদের রাজধানী ছিল নিনেভেহ।
এই সময়ে মেসোপটেমিয়ায় ইহুদি সম্প্রদায়ের প্রথম ডায়াস্পোরা গড়ে ওঠে, যখন ব্যাবিলনীয় নির্বাসনের সময় ইহুদিদের এখানে নিয়ে আসা হয়।
![]() |
Karbala, Iraq on July, 2025. Photo Credit : Mustafa AbdulHadi/Daily News BD |
পারস্য ও গ্রীক শাসন (খ্রিস্টপূর্ব ৫৩৯ অব্দ - ৬৩৭ খ্রিস্টাব্দ): ব্যাবিলনীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর পারস্যের আকামেনিদ সাম্রাজ্য (সাইরাস দ্য গ্রেটের অধীনে) মেসোপটেমিয়া দখল করে। এরপর আলেকজান্ডার দ্য গ্রেটের বিজয়ের পর গ্রীক সেলুসিড সাম্রাজ্যের অধীনে আসে। পরবর্তীতে পার্থীয় এবং সাসানীয় সাম্রাজ্য এই অঞ্চলের নিয়ন্ত্রণ নেয়। এই সময়ে আরব উপদ্বীপ থেকে আরব উপজাতিরা নিম্ন মেসোপটেমিয়ায় চলে আসে।
ইসলামী খিলাফত ও মধ্যযুগ (৬৩৭ - ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দ): ৭ম শতাব্দীর মাঝামাঝি সময়ে মুসলিমদের বিজয়ের মাধ্যমে সাসানীয় সাম্রাজ্যের পতন ঘটে এবং মেসোপটেমিয়া ইসলামের অধীনে আসে। এই সময়েই এই অঞ্চল 'ইরাক' নামে পরিচিতি লাভ করে।
আব্বাসীয় খিলাফত (৭৫০ - ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দ): ৭৬২ খ্রিস্টাব্দে বাগদাদ আব্বাসীয় খিলাফতের রাজধানী হিসেবে প্রতিষ্ঠিত হয় এবং "ইসলামী স্বর্ণযুগে" সংস্কৃতি, বিজ্ঞান ও জ্ঞানচর্চার কেন্দ্রে পরিণত হয়। এটি বিশ্বের অন্যতম প্রধান বুদ্ধিবৃত্তিক কেন্দ্রে পরিণত হয়েছিল।
পরবর্তীতে, বুয়িদ এবং সেলজুক আক্রমণকারীরা বাগদাদের ওপর প্রভাব বিস্তার করে।
মঙ্গোল আক্রমণ ও উসমানীয় শাসন (১২৫৮ - ১৯১৮ খ্রিস্টাব্দ): ১২৫৮ খ্রিস্টাব্দে হালাকু খানের নেতৃত্বে মঙ্গোলরা বাগদাদ আক্রমণ করে এবং আব্বাসীয় খিলাফতের পতন ঘটায়। এই আক্রমণ ইরাকের জন্য এক বিপর্যয় ছিল। এরপর ইরাক বিভিন্ন তুর্কি-মঙ্গোল শাসকদের অধীনে থাকে। ১৫৩৪ থেকে ১৯১৮ সাল পর্যন্ত ইরাক উসমানীয় সাম্রাজ্যের অধীনে ছিল, যদিও ১৭০৪ থেকে ১৮৩১ সাল পর্যন্ত মামলুকদের অধীনে এটি কিছু সময়ের জন্য স্বায়ত্তশাসন লাভ করে।
ব্রিটিশ ম্যান্ডেট ও রাজতন্ত্র (১৯২০ - ১৯৫৮ খ্রিস্টাব্দ): প্রথম বিশ্বযুদ্ধের পর উসমানীয় সাম্রাজ্যের পতনের পর ১৯২০ সালে ব্রিটিশ সাম্রাজ্য ইরাকে ম্যান্ডেট স্থাপন করে। ১৯২১ সালে ব্রিটিশরা হাসেমীয় রাজবংশের অধীনে ফয়সাল প্রথমকে ইরাকের রাজা নিযুক্ত করে। ১৯৩২ সালে ইরাক ব্রিটিশদের কাছ থেকে স্বাধীনতা লাভ করে এবং ইরাক রাজ্য হিসেবে আত্মপ্রকাশ করে।
![]() |
Karbala, Iraq on July, 2025. Photo Credit : Mustafa AbdulHadi/Daily News BD |
প্রজাতন্ত্র ও সাদ্দাম হোসেনের যুগ (১৯৫৮ - ২০০৩ খ্রিস্টাব্দ): ১৯৫৮ সালে একটি সামরিক অভ্যুত্থানের মাধ্যমে রাজতন্ত্রের পতন ঘটে এবং ইরাক একটি প্রজাতন্ত্রে পরিণত হয়। দীর্ঘ রাজনৈতিক অস্থিতিশীলতার পর ১৯৬৮ সালে বাথ পার্টি ক্ষমতায় আসে। ১৯৭৯ সালে সাদ্দাম হোসেন ইরাকের প্রেসিডেন্ট হন। তার শাসনামলে:
ইরান-ইরাক যুদ্ধ (১৯৮০-১৯৮৮): এই দীর্ঘ ও ধ্বংসাত্মক যুদ্ধে দুই দেশেরই ব্যাপক ক্ষয়ক্ষতি হয়।
কুয়েত আগ্রাসন (১৯৯০): ইরাক কুয়েত দখল করলে ১৯৯১ সালে উপসাগরীয় যুদ্ধ শুরু হয় এবং ইরাককে কুয়েত থেকে সরে যেতে বাধ্য করা হয়। এর ফলে আন্তর্জাতিক নিষেধাজ্ঞা আরোপিত হয়।
![]() |
Karbala, Iraq on July, 2025. Photo Credit : Mustafa AbdulHadi/Daily News BD |
ইরাক যুদ্ধ ও বর্তমান পরিস্থিতি (২০০৩ - বর্তমান): ২০০৩ সালে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রের নেতৃত্বে কোয়ালিশন বাহিনী ইরাক আক্রমণ করে এবং সাদ্দাম হোসেনকে ক্ষমতাচ্যুত করে। আগ্রাসনের মূল কারণ হিসেবে ইরাকের গণবিধ্বংসী অস্ত্রের (WMD) উপস্থিতি ও আল-কায়েদার সঙ্গে সম্পর্ক থাকার অভিযোগ করা হলেও, পরে কোনো WMD পাওয়া যায়নি। সাদ্দাম হোসেনকে ২০০৬ সালে মৃত্যুদণ্ড দেওয়া হয়।
আক্রমণের পর ইরাকে একটি গণতান্ত্রিক সরকার গঠনের চেষ্টা করা হলেও, জাতিগত ও সাম্প্রদায়িক সংঘাত, বিদ্রোহ এবং আল-কায়েদার মতো জঙ্গি গোষ্ঠীর উত্থান দেশটির পরিস্থিতিকে অস্থিতিশীল করে তোলে। সাম্প্রতিক সময়ে আইএসআইএল (ISIS) এর উত্থান ইরাককে নতুন করে সংকটের মুখে ফেলেছিল, যা আন্তর্জাতিক সামরিক হস্তক্ষেপের মাধ্যমে দমন করা হয়েছে।
ইরাক আজো তার সমৃদ্ধ অতীত এবং সাম্প্রতিক চ্যালেঞ্জগুলির মধ্যে ভারসাম্য বজায় রেখে একটি স্থিতিশীল ভবিষ্যৎ গড়ে তোলার চেষ্টা করছে।