কাজী আবু মোহাম্মদ খালেদ নিজাম
অবশেষে গাজায় যুদ্ধবিরতি কার্যকর হলো। এর আগে এখন পর্যন্ত নারী, শিশুসহ প্রায় ৭০ হাজার নিরীহ ফিলিস্তিনিকে নির্মভাবে হত্যা করে ইসরায়েল। গাজাকে পরিণত করে ধ্বংসস্তূপে। বিশ্বজুড়ে নিন্দার ঝড় উঠে। বাধা দেয়া হয় গাজাগামী ত্রাণবাহী নৌবহর সুমুদ ফ্লোটিলাকে। গ্রেফতার করা হয় এর যাত্রীদের।
এই প্রেক্ষাপটে গাজা যুদ্ধের অবসান ঘটাতে যুক্তরাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট ডোনাল্ড ট্রাম্পের উদ্যোগের প্রথম ধাপে স্বাক্ষর করেছে ইসরায়েল ও হামাস। যুদ্ধবিরতি ও বন্দি বিনিময় চুক্তি ঘোষণার পর বৃহস্পতিবার (৯ অক্টোবর) উল্লাসে মেতে ওঠে ইসরায়েলি ও ফিলিস্তিনিরা। মিশরের রাষ্ট্র-নিয়ন্ত্রিত কায়রা টিভি জানিয়েছে, শার্ম আল-শেখের সমুদ্রতীরবর্তী রিসোর্ট শহরে শত্রুপক্ষের প্রতিনিধিরা চুক্তিতে স্বাক্ষর করার পর স্থানীয় সময় দুপুরের পর আনুষ্ঠানিকভাবে যুদ্ধবিরতি কার্যকর হয়েছে। ব্রিটিশ বার্তা সংস্থা রয়টার্স এ খবর জানিয়েছে।
ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী বেনিয়ামিন নেতানিয়াহুর দপ্তর জানিয়েছে, ইসরায়েলি মন্ত্রিসভা অনুমোদনের পরই যুদ্ধবিরতি কার্যকর হবে। ওই বৈঠকটি বিকেল ৫টায় হওযার কথা। তবে গাজার বাসিন্দারা জানান, চুক্তি স্বাক্ষরের নির্ধারিত সময়ের কাছাকাছি গাজা শহরে একাধিক বিমান হামলা চালানো হয়েছে। চুক্তির বিস্তারিত বিষয়ে অবহিত একটি সূত্র জানায়, স্বাক্ষরের ২৪ ঘণ্টার মধ্যে ইসরায়েলি সেনারা পিছু হটতে শুরু করবে। চুক্তির অধীনে যুদ্ধ বন্ধ হবে, ইসরায়েল আংশিকভাবে গাজা থেকে সেনা প্রত্যাহার করবে এবং হামাস জিম্মি করে রাখা ইসরায়েলিদের মুক্তি দেবে। বিনিময়ে ইসরায়েলে আটক ফিলিস্তিনিদের মুক্তি দেওয়া হবে।
চুক্তির খবর প্রকাশের পর গাজা ও ইসরায়েলে বন্দিদের পরিবারের সদস্যরা এবং সাধারণ মানুষ আনন্দে আত্মহারা হয়ে ওঠে। ইসরায়েলি বিমান হামলায় ধ্বংসস্তূপে পরিণত হওয়া গাজায়, তরুণরা রাস্তায় নেমে করতালি ও উল্লাস প্রকাশ করে। যদিও ইসরায়েলি হামলা তখনও চলছিল।
তেল আবিবের তথাকথিত ‘হোস্টেজেস স্কয়ারে’ উল্লাস করছিলেন ইসরায়েলিরা। সেখানে উপস্থিত ছিলেন আইনাভ জাউগাউকার, যার ছেলে মাতান এখনও হামাসের হাতে বন্দি থাকা শেষ কয়েকজনের একজন।
সন্দেহ, সংশয় থাকলেও চুক্তি নিয়ে উচ্ছ্বাস দেখা গেছে যুদ্ধ আর অনাহারে ক্লিষ্ট গাজা উপত্যকায়। সেই সাথে বিশ্ব নেতারাও একে স্বাগত জানিয়েছেন।
এই চুক্তিকে ‘ঐতিহাসিক সুযোগ’ হিসেবে বর্ণনা করেছেন জাতিসংঘ মহাসচিব আন্তোনিও গুতেরেস। চুক্তির মাধ্যমে ইসরায়েলি জিম্মিদের মুক্তি এবং ফিলিস্তিনি বন্দি বিনিময়ের পথ সুগম হলো। এর পাশাপাশি গাজা থেকে ইসরায়েলি সেনা প্রত্যাহার এবং সেখানে মানবিক সহায়তার প্রবেশ নিশ্চিত হবে বলেই মনে করা হচ্ছে। শান্তি চুক্তির খবর নিশ্চিত হওয়ার পর বিভিন্ন দেশের রাষ্ট্রপ্রধান এবং আন্তর্জাতিক সংস্থা থেকে জোরালো সমর্থন এসেছে।
দীর্ঘ সময়ের আন্দোলন, সংগ্রাম প্রমাণ করে ফিলিস্তিনিদের নিজস্ব একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছাড়া কোন বিকল্প নেই। ফিলিস্তিনি জনগণের ভাগ্য পরিবর্তন এবং স্থিতিশীল পরিবেশ সৃষ্টি করতে হলে এছাড়া কোন উপায়ও নেই। এমনিতেই ফিলিস্তিনিদের দীর্ঘদিনের লড়াই ও প্রচেষ্টা দেখলে মনে হয় একদিন তারা তাদের জন্য পৃথক একটি ভূমি, একটি স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা করেই ছাড়বে।
ফিলিস্তিনি নয় শুধু সারা বিশ্বের মুসলমানদের প্রথম কিবলা বায়তুল মুকাদ্দাস। এই মসজিদটিকে ইসরায়েল কব্জা করে রেখেছে। সেখানে নামাজ পড়তে গেলে ইসরায়েলি সেনারা ফিলিস্তিনিদের বাধা দেয়। সংঘাত উষ্কে দিয়ে যুদ্ধাবস্থা তৈরি করে। এরপর থেকে ইসরাইলী সেনাদের একের পর এক অভিযানে নিরীহ ফিলিস্তিনি মানুষজন নিহত হয়।
ফিলিস্তিনিদের ন্যায়সঙ্গত অধিকারকে পাশ কাটিয়ে প্রভাবশালী রাষ্ট্র কর্তৃক ইসরাইলকে সমর্থন জানানো একধরণের নিয়মে পরিণত হয়েছে। সংকট সমাধানে জাতিসংঘের যে কোন উদ্যোগকে তারা থুরি মেরে উড়িয়ে দেয়। বিভিন্ন সময় চুক্তির নাম করে ফিলিস্তিনিদের সাথে প্রতারণা করা হয়েছে। যা এবারও হয়েছে। দীর্ঘ হয়েছে লাশের সারি। জাতিসংঘের পাশাপাশি আরব রাষ্ট্র ও মুসলিম দেশগুলোর সংস্থা ওআইসির দায়সারা ভূমিকাও ক্ষুব্ধ করেছে বিশ্বের মুসলিম সমাজকে। এসব কারণে আর কত নিরীহ ফিলিস্তিনিকে প্রাণ দিতে হয় তা কেউ জানেনা।
সবকিছু পর্যালোচনা করলে দেখা যাবে, জেরুজালেমকে রাজধানী করে একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠাই হবে এ অঞ্চলের শান্তির জন্য একমাত্র দাওয়াই। নয়তো সংঘাত, সংঘর্ষের ইতি টানা কখনোই সম্ভব হবেনা। এ বিষয়টি পরাশক্তিগুলো এবং ইসরাইলীরা যত তাড়াতাড়ি বুঝতে পারবে ততই মঙ্গল। আমরা চাই, দ্রুত একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা হোক। এ দাবি বিশ্বের মুসলিম ও মানবতাবাদি সব মানুষের। গাজা দখলের ইসরায়েলি নীল নকশা যেন বাস্তবায়িত না হয় সেজন্য আরব রাষ্ট্রসহ মুসলিম বিশ্বের কার্যকর পদক্ষেপ নিতে হবে। যুদ্ধবিরতি কোন সমাধান নয়, একটি স্বাধীন ফিলিস্তিন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠায়ই স্থায়ী সমাধান। এরপরও এত মানুষকে হত্যার পর এই যে যুদ্ধবিরতি সেটি স্থায়ী হোক, অবসান হোক জুলুমের। বিশ্বের সব মানবতাবাদি মানুষকে এগিয়ে আসতে হবে। আল্লাহ তুমি গাজাসহ ফিলিস্তিনি জনগণের প্রতি সহায় হও। আমিন।
লেখক : শিক্ষক ও কলামিস্ট