মান-হুঁশ হয়ে উঠি মানব অস্তিত্ব টিকিয়ে রাখতে


বাবুল কান্তি দাশ

প্রাণদ ও প্রীতিপদ ব্যবহারের মূলে থাকে মানুষের চরিত্র। যারা সৎ ও বিনয়ী তাদের সব সময় লক্ষ্য থাকে কিভাবে তারা অপরকে সৎভাবে সুখী ও সন্দীপ্ত ক'রে তুলবে। এই আকৃতিই তাদের ব্যবহারের মধ্যে একটা গভীর আন্তরিকতা সঞ্চারিত করে। এবং তা' মানুষের অন্তরকে স্পর্শ করেই। তাদের মধ্যে ভদ্রতার বাড়াবাড়ি বা সৌজন্যের অহঙ্কার থাকে না। অপরের সান্নিধ্যে তারা নিজেরাও সুখী হয়, এবং অপরকেও সুখী ক'রে তোলে। তাদের ব্যবহারের মধ্যে থাকে একটা সহজ স্বাচ্ছন্দ্য। তাই মানুষ লহমায় তাদের আপন হ'য়ে ওঠে। তাদের প্রাণখোলা ব্যবহার মানুষের মনে দাগ কেটে যায়। যারা মান-হুঁশ তাদের পক্ষেই এমনতর ব্যবহার আয়ত্ত করা সম্ভব হয়ে উঠে। আদর্শানুরাগ ও সেবা-বুদ্ধি থাকলে প্রত্যেকের বৈশিষ্ট্য-অনুযায়ী এই রকমটা গজিয়ে ওঠে। ভিতরে যদি প্রীতি ও সেবা-বুদ্ধি না থাকে তাহ'লে মানুষ যতই অন্তরঙ্গতার ভান করুক না কেন তা' কিন্তু মানুষকে মুগ্ধ করতে পারে না। নিজের প্রাণ যদি না জাগে তবে অপরের প্রাণকে স্পর্শ করা যায় না। স্রষ্টা মানুষকে সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে সৃজন করেছেন অত্যন্ত যত্নসহকারে। যার মধ্যে দিয়েছেন মেধা, বোধ, বিবেক, বুদ্ধি, বিবেচনা আর মানবিকতা। কিন্তু মানুষ সেই দুর্লভ বস্তুসমূহ পিছনে ফেলে পশুর থেকেও নিম্ন এক চরিত্রের অধিকারী হয়ে উঠছে প্রতিনিয়ত। তাদের বোধে আসছে না মান ও হুঁশ এই দুইয়ের সমন্বয়েই মানুষ। অর্থাৎ মানুষ এমনই এক উন্নত জীব যার ব্যক্তিত্ব তথা মান রয়েছে এবং সমাজে এই ‘মান’ বজায় রাখতে যে সচেতনতা প্রয়োজন তাকেই বলে ‘হুঁশ’ আর দুইয়ের মেলবন্ধনেই প্রকৃত অর্থে মানুষের সৃষ্টি। তাহলে থেকে একটা ব্যাপার পরিষ্কার যে মান ও হুঁশ এই দুই মানদণ্ডের একটিতে যদি টান পড়ে তবে হারিয়ে যায় তার ব্যক্তিত্ব, বিবেক, হিতাহিত জ্ঞান আর তখনই আমরা দেখি যে একজন দীর্ঘদিনের পরিচিত মানুষও চলে যায় অপরিচিতের তালিকায়। আমরা সাধারণ ভাবে মানুষের বিবেকহীন অবিবেচকের মতো ব্যবহারকেই পশুর সাথে তুলনা করে থাকি। বিশ্বকবি রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর সৃষ্টির অধিকার প্রবন্ধে লিখেছেন? ‘দিন তো যাবেই; এমনি করেই তো দিনের পর দিন গিয়েছে। কিন্তু, সব মানুষেরই ভিতরে এই একটি বেদনা রয়েছে যে, যেটা হবার সেটা হয় নি। দিন তো যাবে, কিন্তু মানুষ কেবলই বলেছে : হবে, আমার যা হবার তা আমাকে হতেই হবে, এখনো তার কিছুই হয় নি। তাই যদি না হয়ে থাকে তবে মানুষ আর কিসের মানুষ, পশুর সঙ্গে তার পার্থক্য কোথায়! পশু তার প্রাত্যহিক জীবনে তার যে-সমস্ত প্রবৃত্তি রয়েছে তাদের চরিতার্থতা সাধন করে যাচ্ছে, তার মধ্যে তো কোনো বেদনা নেই। এখনো যা হয়ে ওঠবার তা হয় নি, এ কথা তো তার কথা নয়। কিন্তু মানুষের জীবনের সমস্ত কর্মের ভিতরে ভিতরে এই বেদনাটি রয়েছে- হয় নি, যা হবার তা হয় নি। কী হয় নি। আমি যা হবো বলে পৃথিবীতে এলুম তাই যে হলুম না, সেই হবার সংকল্প যে জোর করে নিতে পারলুম না। আমার পথ আমি নেব, আমার যা হবার আমি তাই হবো, এই কথাটি জোর করে বলতে পারলুম না বলেই এই বেদনা জেগে উঠছে যে হয় নি, হয় নি, দিন আমার বৃথাই বয়ে যাচ্ছে। গাছকে পশুপক্ষীকে তো এ সংকল্প করতে হয় না, মানুষকেই এই কথা বলতে হয়েছে যে আমি হবো। যতক্ষণ পর্যন্ত এ সংকল্পকে সে দৃঢ়ভাবে ধরতে পারছে না, এই কথা সে জোর করে বলতে পারছে না, ততক্ষণ পর্যন্ত মানুষ পশুপক্ষী-তরুলতার সঙ্গে সমান।’ মানুষও পশুর প্রশ্নের সম্মুখিন, যা রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর এই লেখার মধ্যে একটা স্পষ্ট ধারণা দেয়ার চেষ্টা করেছেন। একদিকে মানুষ প্রকৃতির অংশ, প্রাকৃতিক সত্তা, প্রকৃতিরই সৃষ্টি, বিবর্তনের পথে সক্রিয়ভাবে পরিবেশ ও পরিস্থিতির সাথে ক্রিয়া-প্রতিক্রিয়া গঠন-পুনর্গঠনের সাথে নিজেকে গড়ে তুলেছে। এটাই তার প্রাকৃতিক সত্তা। অন্যদিকে মানুষ অনুশীলনী সত্তা (Being of Praxis) মানুষ নিজেকে গড়ছে, আবার বদলাচ্ছে, আবার প্রকৃতি থেকে নিজেকে পৃথকও করছে; একই সঙ্গে পারিপার্শ্বিক প্রকৃতিকেও বদলে ফেলছে। এভাবে সে প্রাকৃতিক শক্তিকে আরো বেশি করে তার নিয়ন্ত্রণাধীন করে এবং নতুন মানবিক পরিবেশ তৈরি করে। এই সম্পূর্ণ অবস্থাটাই মানবিক। এই দুই ক্ষেত্রেই মানুষ একটা ওতপ্রোত সম্পর্ক ও ক্রিয়ার ফল। মানুষের এই যে অভিযোজন তা এখন রূপ নিয়েছে কুপ্রবৃত্তিতে। ফলস্বরূপ ধীরে ধীরে ধাবিত হচ্ছে তমসাচ্ছন্ন কুটিরে। মানুষের প্রতি মানুষের যে আচরণ বর্তমান সময়ে পরিলক্ষিত হয় তা মানবচরিত্রের অবনমন নয়কি? ধর্ম -বর্ণ - লিঙ্গ -গোত্র- সম্প্রদায় নির্ব্বিশেষে পরস্পর পরস্পরের প্রতি যে অসহিষ্ণুতা, ঘৃণা, অসহযোগিতা, অশুভ আচরণ মানব চরিত্রকে কোনদিকে ধাবিত করছে তা ভাবলে লজ্জায় মাথা নত হয়ে আসে। আমরা ভুলে যায় যে আমাদের জন্ম এক উজ্জ্বল চৈতন্য সত্তা থেকে। যেখানে কারো প্রতি হিংসা, দ্বেষ, বিভেদ বৈষম্যের লেশমাত্র নেই। প্রতিনিয়ত হেয়প্রতিপন্ন হচ্ছি বা করছি। মানুষের আচার আচরণ পশুদেরকেও লজ্জিত করছে। এক ভয়ানক দুঃসময়ে উপনীত মানবগোষ্ঠী ! ভাগে-ভোগের দুর্দমনীয় স্পৃহা মানুষকে মান-হুঁশে উন্নীতকরণে যে প্রতিবন্ধকতা তা আমরা সত্তাবিধ্বংসী ক্রিয়ার লিপ্ত থাকায় অনুভবে নিতে অপারগ। আজ মানুষ নিজের ছাড়া কারোর কথা ভাবে না। পাশের মানুষ খাবার তো দূরে থাক খাবার পানি পেল কিনা তা জানার চেষ্টাও করে না। মানুষ হয়ে মানুষের প্রতি যে ভালোবাসা তা দিনদিন কেমনজানি রহিত হচ্ছে। সহযোগিতা সহমর্মিতা নেই বললে চলে। মানবচরিত্রের এই ক্রমাবনতি মানবসভ্যতার জন্য সংকট সৃষ্টি করছে। " বড়'র প্রতি শ্রদ্ধানতি ছোট'র প্রতি স্নেহ, যেই হারালি - অমনিরে তোর রইল না আর কেহ। " নৈতিকতা দাবী করার আগে নিজ জীবনকে নৈতিক নিয়ন্ত্রণে নিয়ন্ত্রিত করে তুলতে হবে। আর এই আত্মনিয়ন্ত্রণ ঐ দাবীকে কবুল করবে। অন্যথায় তা প্রত্যাশা করা বিড়ম্বনা মাত্র। বহুল শ্রুত - পশু পশুত্ব নিয়ে জন্মগ্রহণ করে, কিন্তু মানুষ মনুষ্যত্ব নিয়ে জন্মগ্রহণ করে না। তাঁকে তা অর্জন করতে হয়। এই অর্জন যথাযথ হলে মানুষ হয়ে উঠে মান-হুঁশ। মানুষের মনুষ্যত্বের পরিচায়ক হচ্ছে -দুর্বলকে রক্ষা করা আর দুর্জনকে বিনাশ করা। কিন্তু মনুষ্যত্বের বিকাশে মনোযোগী না হওয়ায় এবং  ব্যাহত হওয়ায় মানুষ মানুষের কাছে গৃহপালিত পোষা পশুর আদরও পায় না। বিশ্বব্যাপী মনুষ্য মর্যাদার যে অবনমন সত্যিই উদ্বেগজনক। আর এই অবনমন কখনো আইনের হাত ধরে উত্তরণ সম্ভব নয়। যা সম্ভব জন্মগত শুদ্ধতায়, সুশিক্ষায় এবং পরিবারে। পিতা-মাতার পরিশীলিত ও পরিশুদ্ধ আচার-আচরণ, সংযম-নিয়ন্ত্রণ শিশুর বিকাশ ও বর্দ্ধনাকে প্রভাবিত করে। ছোট থেকে শিশুর সামনে ওমনতরো আদর্শিক চরিত্র উদ্ভাসিত হলে শিশু তার প্রভাবে প্রভাবান্বিত হয়ে উঠে। নিজেকে আদর্শিক সুনাগরিক হিসেবে  গড়ে তুলতে সচেষ্ট থাকে। পিতা-মাতার আচার আচরণ এবং পারিবারিক শিক্ষা আদর্শিক না হলে সর্বোপরি পিতা-মাতা অনিয়ন্ত্রিত জীবন যাপনে অভ্যস্ত হলে সন্তানের ভিতর কুপ্রবৃত্তি মাথাচাড়া দিয়ে উঠে। বিদ্যালয়ে ছেলে মেয়ে যতই বিদ্যা শিখুক না, বাড়ীর শিক্ষা সুষ্ঠু নইলে শিষ্ট স্বভাব হয় না। তাই পারিবারিক শিক্ষা সন্তানের জীবন গঠনে তাৎপর্যপূর্ণ। আজ চারিদিকে যদি তাকিয়ে দেখি তাহলে একটা বিষয় সুস্পষ্ট যে, সকল ক্ষেত্রে কুপ্রবৃত্তি এবং দূর্বৃত্তায়নের মহোৎসব। ঠগবাজ, বাটপার, প্রতারকে দেশ সয়লাব। বিশেষ করে একশ্রেণির লোক মনে করছে, মনুষ্য মর্যাদার অবনমন ঘটিয়ে নিজেকে বীরপুরুষ হিসেবে পরিগনিত করা! তা যে নিজের পায়ে কুড়াল মারার শামিল তো বোধে আসে না। কুপ্রবৃত্তির স্রোতে নিজেকে ভাসিয়ে দিয়ে উচ্ছৃঙ্খলতার ঢেউয়ে আন্দোলিত হয়ে উঠে। এক করুণ পরিণতি যে হাতছানি দিয়ে ডাকছে তা আর ঠাহর করতে পারছে না। স্মরণে রাখতে হবে - " পরের মঙ্গল কামনায় নিজ মঙ্গলের প্রসূতি। " অন্যকে হেয়প্রতিপন্ন করে নিজেকে কখনো মহৎ করা যায় না। আজকের সময় পুরোটা কেমনজানি নষ্ট ভ্রষ্ট। 

কথায় কথায় মারধর, ভাঙচুর, অমান্যতা আজকের সময়ে বীরত্বের দৃষ্টান্ত হয়ে দাঁড়িয়েছে! এর কুফল যে সুদূরপ্রসারী তা আমাদের চেতনার রাজ্যে ক্রিয়া করছে না। প্রতিনিয়ত মানুষের জীবন ও বৃদ্ধিকে ব্যাহত করে চলেছি তা সুস্থ পরিবেশের পরিচায়ক নহে। এখানে আরও একটি বিষয় উল্লেখ করার মতো যে,  মানুষের জীবন বৃদ্ধি ও রক্ষায় খাদ্য, চিকিৎসা, ঔষধ ভেজাল আর ভেজাল। অসাধু ব্যবসায়ী, অতি মুনাফালোভী, মজুদদার এসবে ভরপুর প্রিয় মাতৃভূমি। তাদের দোর্দণ্ড প্রতাপে ক্ষত-বিক্ষত সাধারণ মানুষের জীবন। শিক্ষা পারছে না শুদ্ধতায় আলোকিত করতে, ধর্ম পারছে না নীতি নৈতিকতায় রাখতে, আইন পারছে না পরিশুদ্ধ করতে! এক দূর্বিষহ পরিবেশ। যা দিনদিন বেড়েই চলছে। স্রষ্টা ভীতি মানুষের মাঝে নেই বললে চলে। অথচ দেশের মানুষ ধর্মপ্রাণ। সকল ধর্মের মানুষ নিয়মিত তারই আবহে জীবন অতিবাহিত করে। তারপরও মানুষের মাঝে মানুষের প্রতি অসহিষ্ণু আচরণ সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীবকে প্রশ্নবিদ্ধ করে তুলে। মনুষ্যত্বের এমনতরো অবক্ষয় সত্যি অকল্পনীয়। লোভ মোহ এবং ভোগের যে উন্মাদনা তা প্রতিনিয়ত মনুষ্য চরিত্রের অবনমন ঘটাচ্ছে। প্রতিযোগিতা আর প্রতিদ্বন্দ্বিতা যেখানে তা প্রাকৃতিক নিয়ম কিন্তু তা আজ ক্ষমতার দাপট আর পেশীশক্তির কাছে ম্রিয়মাণ। সৎ প্রবৃত্তিজাত মানুষগুলো কুপ্রবৃত্তিজাত মানুষের অত্যাচার আর নির্যাতনে কোনঠাসা। ক্ষেত্রমতে গৃহবন্দী। ক্রমাগত মানুষ যে মনুষ্যত্ববোধ, মূল্যবোধ এবং বিবেকবর্জিত হয়ে উঠছে তা কখনো শুভদায়ক হবে না। যদুবংশ যেমন নিজেদের মধ্যে বিবাদ বিসম্বাদে পরস্পরের সাথে লিপ্ত হয়ে নিশ্চিহ্ন হয়ে গেছে ঠিক তেমনই অবস্থা ধারণ করবে নিঃসন্দেহে। অসৎ এর সংক্রমণ অত্যন্ত ভয়াবহ। যা প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম পর্য্যন্ত গড়ায়। দেহে ক্ষীণ বুদ্ধিতে হীন ব্যক্তিরা শত অনুগত থাকার পরও তা'দের উপর শোষণ বঞ্চনা নিপীড়ন ঐ সকল ক্ষমতাবান ও পেশীশক্তির আত্মপ্রসাদ লাভের উত্তম পন্থা। বুদ্ধিমানরা এদের ছলে বলে কৌশলে নিয়ত বিব্রত বিভ্রান্ত প্রতারণা করে যাচ্ছে। সমাজে শান্তিতে সহাবস্থান ঐসকল বুদ্ধিমান শক্তিমান ক্ষমতাবানদের চক্ষুশূল। বিভাজন বৈষম্য এদের সাধনা। সিদ্ধি তাই অস্হিরতা অরাজকতা বিশৃঙ্খলা। সমাজে এখন প্রয়োজন আত্মপ্রত্যয়ী অহং সচেতন এবং আত্মমর্যাদাসম্পন্ন মানুষের। যা সম্ভব প্রকৃত সুশিক্ষায়, সুশাসনে এবং বৈষম্যহীন সমাজ ব্যবস্হায়। মানবপ্রীতি সদাচার সহাবস্থান ব্যতিরেক সমাজ রাষ্ট্রের স্থিতিশীলতা সংরক্ষিত হবে না। সহযোগে সহভাগে সপারিপার্শ্বিক পথচলা হোক মানবচরিত্রের অন্যতম অনুষঙ্গ। এর ব্যতয়ে পারিবারিক হোক আর সামষ্টিক জীবন হোক সুখ থেকে যাবে অধরা। দেখা মিলবে না শান্তির। আমাদের চলনা যদি সত্য ও সুন্দরে না হয় তার কুফল ভোগ করতেই হবে। নিস্তার পাবে না প্রজন্ম থেকে প্রজন্ম। ধর্ম এবং নীতি নৈতিকতায় যদি আমাদের শ্রদ্ধা ভক্তি না থাকে কোনোকিছুতেই কিছু হবে না। ভক্তিরূপ জল ত্যাগ করে আসক্তিরূপ বালির চড়ায় বহুদূর যাওয়া যায় না। কারণ দুঃখরূপ সূর্যের তাপে আসক্তিরূপ বালির চড়া গরম হলে ফিরে আসা মুশকিল হবে। তাই অল্প উত্তপ্ত হতে হতে যদি না ফিরে আসতে পারি তবে শুকিয়ে মরতে হবে। এই বোধ তখনই জাগ্রত হবে যখন পারিবারিক জীবন চলনা হবে আদর্শিক। সপারিপার্শ্বিক হবে জীবনের চেতনা। সুখ শান্তি খুঁজে নিতে পারব সহযোগিতা আর সহভাগিতায়। সুখ' মানে তা'ই যা সত্তা বা জীবনটাকে সুস্থ, সজীব ও উন্নত করে পারিপাশ্বির্ককে অমনতর করে তোলে, আর প্রকৃত ভোগ তখনই সেখানে যখন তাহা পরমসত্তাকে অভিনন্দিত করে। অন্যথায় যা তা হবে আসুরিক প্রবৃত্তির চর্চা। এই বোধের বিকাশ ও বিস্তরণ আমাদের দায়িত্ব ও কর্তব্য। আর তা'তেই মানুষ হিসেবে আমাদের সার্থকতা। তখনই ফুটে উঠবে মানুষের নান্দনিক সৌন্দর্য, মনুষ্য চরিত্রের সত্য সুন্দরের মাধুর্য। কবিগুরুর ভাষায় -

সত্য যে কঠিন, কঠিনেরে ভালোবাসিলাম, সে কখনো করে না বঞ্চনা। আমৃত্যুর দুঃখের তপস্যা এ জীবন, সত্যের দারুণ মূল্য লাভ করিবারে..। তাই সুবিধার ডাকে নয়, সত্যের ডাকে সাড়া দিই। আলোকিত হই। সমাজকে করি সমৃদ্ধ, দেশকে করি উন্নত। সুবিধা আজকের, সত্য চিরকালীন। সুবিধা সংকোচনের, সত্য সম্প্রসারণের। সুবিধাবাদী বিধ্বস্তি ও ধ্বংসের কারণ। সত্যবাদী সৃজন মননে সুন্দরে উদ্ভাসিত পথপ্রদর্শক। সুবিধাভোগী, সুবিধাবাদী সামাজিক অস্হিরতার কারণ। সত্যবাদী সামাজিক স্হিতিশীলতার দৃষ্টান্ত। সুবিধা'য় নয়, সত্যে নিমগ্ন হই। সার্থক করি মানবজন্মকে। স্হায়িত্ব দিই মানব সভ্যতার। প্রামাণিক হই সৃষ্টির শ্রেষ্ঠ জীব হিসেবে। আসলে মানবচরিত্র বড়ই বৈচিত্র্যময়। ক্ষণে ক্ষণে রঙ বদলায়, বোল পাল্টায়। মানুষের মনস্তত্ত্ব সম্পর্কে একটু পড়াশোনা করলে আপনি জানতে পারবেন, মানুষ অন্যকে ঘৃণা করে, অপছন্দ করে, হত্যা করে নানা কারণে। ওর বুদ্ধি বেশি, আমার কম কেন? ওর টাকা বেশি, আমার কম কেন? ওর সম্মান বেশি, আমার কম কেন? রিদম জিরো এবং দাস এক্সপেরিমেন্ট আপনাকে শেখাবে, একটা মানুষের কাউকে ঘৃণা, অপছন্দ বা অত্যাচার করতে আসলে কোনো কারণ লাগে না। একজন মানুষ কোনোরকম কারণ ছাড়াই আরেকজনকে হিংসা করে, ক্ষতি করে, তার বদনাম রটায়, কেননা মানুষের স্বভাবই অমন। মানুষ কোনোদিনই শান্তিকামী ছিল না, নয় এবং থাকবেও না। সে সবসময়ই হিংস্র, লোভী, বর্বর এবং ভণ্ড। তাহলে প্রশ্ন জাগে, এই দুনিয়ায় কি ভালো মানুষ বলে কেউ নেই? হ্যাঁ, আছে হাতেগোনা দুচারজন। বাকিরা সুযোগের অভাবে ভালো। আর হাতেগোনা এই দুচারজন দ্বারা মানবসভ্যতা এখনো বহমান। ভোগের অনিয়ন্ত্রিত চাহিদা, লোভ মোহের আতিশয্যে মানুষ হয়ে উঠে অমানুষে। মাথাচাড়া দেয় পাশবিকতা। নেমে আসে বিপর্যয় বিশৃঙ্খলা। কেবল মানুষই বলে, আশার অন্ত নাই। পৃথিবীর আর-কোনো জীব এমন কথা বলে না। আর-সকল প্রাণী প্রকৃতির একটা সীমার মধ্যে প্রাণ ধারণ করে এবং তাহার মনের সমস্ত আকাঙক্ষাও সেই সীমাকে মেনে চলে। জন্তুদের আহার বিহার নিজের প্রাকৃতিক প্রয়োজনের সীমাকে লঙ্ঘন করতে চায় না। এক জায়গায় তাদের সাধ মেটে এবং সেখানে তারা ক্ষান্ত হতে জানে। অভাব পূর্ণ হলে তাদের ইচ্ছা আপনি থেমে যায়, তার পরে আবার সেই ইচ্ছাকে তাড়না করে জাগানোর জন্য তাদের দ্বিতীয় আর-একটা ইচ্ছা নাই। মানুষের প্রকৃতিতে আশ্চর্য এই দেখা যায়, একটা ইচ্ছার উপর সওয়ার হয়ে আর-একটা ইচ্ছা চেপে আছে। পেট ভরে গেলেও খাবার ইচ্ছা  যখন আপনি মিটে  যায়, তখনো সেই ইচ্ছাকে জোর করে জাগিয়ে রাখার জন্য মানুষের আর-একটা ইচ্ছা তাগিদ করতে থাকে। সে কোনোমতে চাট্‌নি খেয়ে ঔষধ প্রয়োগ করে, আহারের অবসন্ন ইচ্ছাকে প্রয়োজনের ঊর্ধ্বেও চালনা করতে থাকে। এতে মানুষের যথেষ্ট ক্ষতি করে। কারণ, এটি স্বাভাবিক ইচ্ছা নয়। স্বাভাবিক ইচ্ছা সহজেই আপন প্রাকৃতিক স্বভাবের সীমার মধ্যে পরিতৃপ্ত হয়ে থাকে। আর, মানুষের এই অস্বাভাবিক ইচ্ছা কিছুতেই তৃপ্তি মানতে চায় না। তখনই মানুষ মনুষ্যত্বের বিলোপ ঘটিয়ে কুপ্রবৃত্তিতে ভর করে উদ্দাম নৃত্য করতে থাকে। লোভ মোহ ভোগের স্পৃহা প্রচণ্ড বেগে ধাবিত হয়। মনুষ্য সত্তার অবনমন ঘটিয়ে অমানুষিক কার্যে লিপ্ত হয়। হারিয়ে ফেলে হিতাহিত জ্ঞান। ঝাপিয়ে পড়ে অন্যের মনুষ্য মর্যাদা হরণে। এমনি করে সমাজ রাষ্ট্রে দুর্বৃত্তায়নের চাষাবাদ শুরু হয়। নষ্ট হতে থাকে পরিবেশ। রুদ্ধ হয় সমাজ প্রগতি। কাউকে দেবার জন্য সবচেয়ে ভালো উপহার, তার অনুভূতিকে অনুভব করা এবং সেটাকে সম্মান দেওয়া। যার অন্তরটা মানবিকতায় ভরা, মানুষ হিসেবে সেই সেরা। মানুষ মানুষের জন্য। সবাই সবার পাশে থাকলে এই পৃথিবীটা আরো সুন্দর থেকে সুন্দরতর হবে এই আশা রাখি। মানুষকে মান-হুঁশে উন্নীত করার সাধনাই হোক একমাত্র ব্রত। 

লেখকঃ  শিক্ষক  ও  প্রাবন্ধিক 

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন