ন্যায়বিচারের বাস্তবতা মানবাধিকার রক্ষার মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে হবে : মোঃ শামছুল আলম


ডেক্স রিপোর্ট : মানবাধিকার মানুষের জন্মগত ও অবিচ্ছেদ্য অধিকার। মানুষ পৃথিবীর কোন ভূখণ্ডে জন্ম নিল, তার চেহারা, ধর্ম, ভাষা, লিঙ্গ বা সামাজিক অবস্থান কী—এসবের ভিত্তিতে মানবাধিকারের কোনো তারতম্য ঘটে না। মানবাধিকার এমন এক ধারণা, যার ভিত্তি মানুষের মর্যাদা। মানুষের জন্মের সঙ্গে সঙ্গে যে মর্যাদা তার অন্তর্নিহিত থাকে, সেই মর্যাদাকে রক্ষা করার জন্যই মানবাধিকার প্রতিষ্ঠিত হয়েছে। ফলে মানবাধিকার রাষ্ট্র বা ক্ষমতাসীন কোনো শক্তির দান নয়; এটি মানুষের স্বাভাবিক অস্তিত্বের অপরিহার্য বৈধতা।

মানবাধিকারের ধারণা গভীরভাবে বিশ্লেষণ করলে দেখা যায় যে এটি কেবল রাষ্ট্রীয় আইন বা আন্তর্জাতিক নথির বিষয় নয়; বরং এটি মানুষের সভ্যতা, নীতি, ন্যায়বোধ ও মানবিক চেতনার বহিঃপ্রকাশ। মানুষ যখন তার জীবনকে অর্থবহ করতে চায়, তখন তার প্রয়োজন স্বাধীনতা। যখন সে তার চিন্তা প্রকাশ করতে চায়, তখন প্রয়োজন মতপ্রকাশের অধিকার। যখন সে সমাজে সমানভাবে বাঁচতে চায়, তখন প্রয়োজন সমতা ও ন্যায়বিচার। আর যখন সে ভয়মুক্ত জীবন চায়, তখন প্রয়োজন নিরাপত্তা। এই সমস্তকিছুর সমন্বয়ই হলো মানবাধিকার।

একটি রাষ্ট্রের মানবাধিকার রক্ষা করার দায়িত্ব অপরিসীম। রাষ্ট্র যদি নাগরিকের অধিকার রক্ষায় সফল হয়, তবে সমাজে ন্যায়বোধ, শান্তি, স্থিতিশীলতা এবং সমতা প্রতিষ্ঠিত হয়। কিন্তু রাষ্ট্র ব্যর্থ হলে অধিকারবঞ্চনা স্বাভাবিক হয়ে যায়, এবং মানুষ রাষ্ট্রযন্ত্রের ওপর আস্থা হারায়। মানবাধিকার রক্ষার প্রশ্নে রাষ্ট্রকে তিনটি স্তরে কাজ করতে হয়—অধিকার লঙ্ঘন থেকে মানুষকে রক্ষা করা, অধিকার নিশ্চিত করার ব্যবস্থা গড়ে তোলা এবং নিজের প্রতিষ্ঠানগুলোর স্বচ্ছতা ও জবাবদিহিতা বজায় রাখা। এ তিনটি দায়িত্ব সঠিকভাবে পালন করা হলে মানবাধিকার রক্ষা সম্ভব হয়।

তবে বাস্তবতা হলো—বিশ্বের বিভিন্ন দেশে, বিশেষ করে উন্নয়নশীল দেশে মানবাধিকার লঙ্ঘন নানা রূপে দেখা যায়। রাষ্ট্রীয় কর্তৃপক্ষের কর্তৃত্ববাদী আচরণ, দমননীতি, মতপ্রকাশের স্বাধীনতায় বাধা, গণমাধ্যম নিয়ন্ত্রণ, বিরোধী মতের দমন—এসব রাষ্ট্রীয় লঙ্ঘন মানুষের স্বাধীনতা ও নিরাপত্তাকে হুমকির মুখে ফেলে। আবার সামাজিক কাঠামোর মধ্যেও লঙ্ঘন ঘটে—নারীর প্রতি সহিংসতা, শিশুশ্রম, বাল্যবিবাহ, জাতিগত বৈষম্য, ধর্মীয় বিদ্বেষ, অর্থনৈতিক অসমতা এসবই মানুষের মৌলিক অধিকারকে ক্ষুণ্ণ করে।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের আরেকটি গভীরতর রূপ হলো কাঠামোগত বা প্রাতিষ্ঠানিক লঙ্ঘন। এটি সরাসরি হয় না, কিন্তু সমাজের নীতিনির্ধারণী ব্যবস্থার মধ্যেই বৈষম্য গেঁথে থাকে। উদাহরণ হিসেবে বলা যায়—দারিদ্র্য, অশিক্ষা, স্বাস্থ্যসেবার অভাব, অপ্রতুল কর্মসংস্থান, বিচার ব্যবস্থার ধীরগতি, পুলিশের নির্যাতন—এসব কাঠামো যখন মানুষের অগ্রগতিতে বাধা সৃষ্টি করে, তখন মানবাধিকার লঙ্ঘন দীর্ঘমেয়াদী ও গভীর সংকট সৃষ্টি করে। অনেক সময় মানুষ বুঝতেই পারে না যে তার অধিকার লঙ্ঘিত হচ্ছে, কারণ কাঠামোই এমনভাবে সাজানো থাকে যে বঞ্চনা যেন স্বাভাবিক।

মানবাধিকার লঙ্ঘনের সামাজিক পরিণতি ভয়াবহ। এতে ব্যক্তি মানহীনতার শিকার হয়, পরিবার ধ্বংস হয়, সমাজে অবিশ্বাস জন্মায় এবং রাষ্ট্রে অস্থিরতা বেড়ে যায়। যে সমাজে ন্যায়বিচার অনুপস্থিত, সেখানে অপরাধ বাড়ে, শোষণ স্থায়ী হয় এবং মানুষ তার সম্ভাবনার পূর্ণ বিকাশ ঘটাতে পারে না। অর্থনৈতিক উন্নয়নও ক্ষতিগ্রস্ত হয়, কারণ উন্নয়ন তখনই টেকসই হয় যখন তা মানবিক, বৈষম্যহীন ও অন্তর্ভুক্তিমূলক হয়।

এই বাস্তবতায় মানবাধিকার রক্ষায় নাগরিক সমাজ ও মানবাধিকার সংগঠনগুলো অপরিহার্য ভূমিকা পালন করে। আইন সহায়তা কেন্দ্র (ASK) ও বিভিন্ন মানবাধিকার ফাউন্ডেশন, গবেষণা প্রতিষ্ঠান, সাংবাদিক সংগঠন এবং নাগরিক আন্দোলনগুলি মানবাধিকার সুরক্ষা, সচেতনতা বৃদ্ধি, তথ্য তুলে ধরা এবং আইনি সহায়তা প্রদানের মাধ্যমে মানুষের পাশে দাঁড়ায়। তারা সমাজে একটি মানবিক দৃষ্টিভঙ্গি গড়ে তোলে এবং রাষ্ট্রকে জবাবদিহিমূলক অবস্থানে রাখতে সাহায্য করে। গণমাধ্যমও মানবাধিকার রক্ষার ক্ষেত্রে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে—কারণ তথ্য প্রকাশিত হলে জনমত তৈরি হয়, আর জনমতই রাষ্ট্রকে নীতিগত পরিবর্তনে বাধ্য করতে পারে।

সমগ্র আলোচনায় পরিস্কার হয়—মানবাধিকার রক্ষা কেবল আইনি প্রয়োগ নয়, এটি একটি বৃহত্তর নৈতিক দায়িত্ব। মানুষের প্রতি সম্মান, সমতা ও ন্যায়বিচারবোধ যদি সমাজে না থাকে, তবে মানবাধিকার রক্ষার আইনও কার্যকর হতে পারে না। মানবাধিকার তাই মানবিকতার ভিত্তি। রাষ্ট্র, সমাজ ও ব্যক্তি—তিন স্তরেই মানবাধিকার রক্ষার মূল্যবোধ প্রতিষ্ঠা করতে হবে। মানুষ যেন ভয়, বৈষম্য, দমন ও অপমান ছাড়া বাঁচতে পারে—এই আকাঙ্ক্ষা পূরণের মধ্যেই মানবাধিকারের প্রকৃত সার্থকতা নিহিত। যে সমাজ মানবাধিকার রক্ষা করে, সেই সমাজই প্রকৃত অর্থে সভ্য, ন্যায়ভিত্তিক ও মানবিক সমাজ।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন