সংবাদমাধ্যম নয়, সরাসরি গণতন্ত্র-মতপ্রকাশের স্বাধীনতার ওপর আঘাত



জানুয়ারিতে সাংবাদিকদের মহাসম্মেলনের ঘোষণা : বিচার না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চলবে

মো: লুৎফর রহমান (খাজা শাহ্) :  দৈনিক প্রথম আলো ও ডেইলি স্টার কার্যালয়ে হামলার ঘটনায় গভীর উদ্বেগ ও ক্ষোভ প্রকাশ করেছেন দেশের বরেণ্য নাগরিক, সুশীল সমাজের প্রতিনিধিগণ, ব্যবসায়ী প্রতিনিধি, সাংবাদিক, সাংবাদিকদের বিভিন্ন সংগঠন, লেখক, বুদ্ধিজীবী ও বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতারা। তাঁরা বলেছেন, এই হামলা কোনো একটি সংবাদমাধ্যমের বিরুদ্ধে নয়; এটি সরাসরি গণতন্ত্র, মতপ্রকাশের স্বাধীনতা ও নাগরিক অধিকারের ওপর আঘাত বটে।

আর এই হামলায় জড়িতদের বিচার ও সংবাদমাধ্যমের পূর্ণ স্বাধীনতা নিশ্চিত না হওয়া পর্যন্ত আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছে সংবাদপত্রের মালিকদের সংগঠন নিউজ পেপার্স ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব)। সংগঠনের সভাপতি এ কে আজাদ জানিয়েছেন, আগামী জানুয়ারির মাঝামাঝি সময়ে সারা দেশের সাংবাদিকদের নিয়ে ঢাকায় একটি মহাসম্মেলন করা হবে এবং সেখান থেকে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে।

গতকাল রাজধানীর প্যান প্যাসিফিক সোনারগাঁও হোটেলে ‘মব ভায়োলেন্সে আক্রান্ত বাংলাদেশ’ শীর্ষক এক প্রতিবাদ সভায় এসব কথা বলেন বক্তারা। সম্পাদক পরিষদ ও নিউজ পেপার্স ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) যৌথভাবে এ সভার আয়োজন করে।

এই প্রতিবাদ সভায় দৈনিক ইনকিলাব সম্পাদক এ এম এম বাহাউদ্দীনসহ নোয়াব ও সম্পাদক পরিষদের নেতৃবৃন্দ উপস্থিত ছিলেন। এছাড়া বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের নেতা, পেশাজীবী সংগঠন, ব্যবসায়ী সংগঠন, সাংবাদিক সংগঠন ও নাগরিক সমাজের প্রতিনিধিসহ নানা শ্রেণি-পেশার মানুষ সংহতি জানান। সভা শেষে হোটেলের সামনে মানববন্ধন কর্মসূচি পালন করা হয়। প্রতিবাদ সভায় সংহতি প্রকাশ করে বিএনপি মহাসচিব মির্জা ফখরুল ইসলাম আলমগীর বলেন, এই হামলা সরাসরি গণতন্ত্রের ওপর আঘাত। স্বাধীনভাবে চিন্তা ও কথা বলার অধিকারের ওপর আবার আঘাত এসেছে। ৭৮ বছর বয়সী এই রাজনীতিক বলেন, তিনি সারাজীবন একটি স্বাধীন-সার্বভৌম গণতান্ত্রিক বাংলাদেশের স্বপ্ন দেখেছেন, কিন্তু আজ যে বাংলাদেশ তিনি দেখছেন, তা তাঁর কল্পনার সঙ্গে মেলে না। কোনো রাজনৈতিক দল বা সংগঠনের চিন্তা নয়, সব গণতন্ত্রকামী মানুষের এখন এক হওয়ার সময় এসেছে। শুধু একাত্মতা জানালেই চলবে না, রুখে দাঁড়াতে হবে।

সম্পাদক পরিষদের সভাপতি ও নিউ এজ সম্পাদক নুরুল কবীর বলেন, হামলাকারীদের উদ্দেশ্য ছিল সংবাদমাধ্যমের ভেতরে থাকা মানুষদের হত্যা করা। তিনি বলেন, যখন অফিসে সবাই কাজ করছিল, তখন চারপাশ থেকে আগুন লাগানো হয়েছে। ফায়ার সার্ভিসকে বাধা দিয়ে মধ্যযুগীয় কায়দায় পুড়িয়ে মারতে চাওয়া হয়েছে।

নুরুল কবীর বলেন, গণমাধ্যমের নিজস্ব সম্পাদকীয় নীতি থাকতে পারে, সেটি অপছন্দ হলেই আগুন দিয়ে পুড়িয়ে দেয়া কোনো গণতান্ত্রিক প্রক্রিয়া নয়। এই ধরনের সহিংসতা রোধ করা না গেলে শুধু সংবাদপত্র নয়, গোটা সমাজব্যবস্থা ও উন্নতির সম্ভাবনা ধ্বংস হয়ে যাবে।

নিউজ পেপার্স ওনার্স অ্যাসোসিয়েশন অব বাংলাদেশ (নোয়াব) সভাপতি এ. কে. আজাদ অনুষ্ঠানে তাঁর সমাপনী ভাষণে বলেন, আগামী জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সারাদেশের সকল সাংবাদিককে সঙ্গে নিয়ে এই ঘটনার প্রতিবাদ জানিয়ে মহাসমাবেশ করা হবে। সেখান থেকে পরবর্তী কর্মসূচি ঘোষণা করা হবে। এই হামলার বিচার না হওয়া পর্যন্ত আমাদের কর্মসূচি অব্যাহত থাকবে।

ডেইলি স্টারের সম্পাদক ও প্রকাশক মাহফুজ আনাম বলেন, আমাদের ২৬-২৭ জন সহকর্মী ছাদে আটকে পড়েছিলেন। অথচ ফায়ার ব্রিগেডকে আসতে দেয়া হয়নি। তারা শুধু ভবন পুড়িয়ে দিতে আসেনি, তারা সাংবাদিকদের হত্যা করতে চেয়েছিল। মতপ্রকাশ তো অনেক পরের বিষয়, এখন বিষয়টি বেঁচে থাকার অধিকারের প্রশ্ন এসে দাঁড়িয়েছে।

ট্রান্সপারেন্সি ইন্টারন্যাশনাল বাংলাদেশের (টিআইবি) নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামান বলেন, বাংলাদেশের রাষ্ট্রকাঠামোর কেন্দ্রস্থলে মবতন্ত্র শুরু হয়েছে, যা সচিবালয়ের অভ্যন্তরে বিকশিত হয়েছে। যারা এখন ক্ষমতায় আছে তারা মবতন্ত্রের পেছনের শক্তিকে তাদের ক্ষমতাকাঠামোর স্তম্ভ হিসেবে বিবেচনা করছে। একে প্রতিহত করা আমাদের সবার দায়িত্ব। হামলার সময় সরকারের রহস্যজনক নীরবতা নিয়ে গভীর উদ্বেগ প্রকাশ করে তিনি প্রশ্ন রাখেনÑ জাতীয় নিরাপত্তার দায়িত্বে থাকা প্রধান উপদেষ্টার কার্যালয়, স্বরাষ্ট্র মন্ত্রণালয় ও সেনাবাহিনী আসলে কী করছে?

জুলাই গণঅভ্যুত্থান ও তার পরবর্তী সময়ে যে বাংলাদেশের প্রত্যাশা করা হয়েছিল, বর্তমান পরিস্থিতি সেদিকে যাচ্ছে না বলে মন্তব্য করে নাহিদ ইসলাম বলেন, জুলাই অভ্যুত্থানের চেতনা ও স্লোগান ব্যবহার করে সংবাদমাধ্যমে হামলা চালানো কোনো সাধারণ ক্ষোভের বহিঃপ্রকাশ নয়, বরং এটি একটি পরিকল্পিত অপরাধ।

তিনি বলেন, ফ্যাসিবাদী শক্তি জুলাই অভ্যুত্থানকে ছোট করতে ‘মব ভায়োলেন্স’ বা ‘মবোক্রেসি’ শব্দগুলো ব্যবহার করত বলে আগে আমি এর সঙ্গে একমত ছিলাম না। কিন্তু বর্তমানে যা ঘটছে, তাকে মব ভায়োলেন্স বলা যায় না; এটি সম্পূর্ণভাবে পরিকল্পিত অপরাধ। এর উদ্দেশ্য দেশের রাজনীতি ও নির্বাচন ব্যবস্থাকে অস্থিতিশীল করা।

নাহিদ অভিযোগ করেন, শরীফ ওসমান হাদির মৃত্যুকে ঢাল হিসেবে ব্যবহার করে একটি গোষ্ঠী প্রথম আলো, দ্য ডেইলি স্টার ও বিভিন্ন সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের ওপর হামলা চালিয়েছে।

হামলার রাতে তাৎক্ষণিক প্রতিরোধ গড়ে তুলতে না পারায় নিজের অসহায়ত্বের কথা জানিয়ে নাহিদ ইসলাম বলেন, জুলাই গণঅভ্যুত্থানের নামে মিডিয়ার ওপর আক্রমণ বা প্রতিষ্ঠান ভাঙচুর কোনোভাবেই বরদাশত করা হবে না। যারা এর পক্ষে সম্মতি তৈরি করার চেষ্টা করবে, তাদের বিরুদ্ধেও কঠোর ব্যবস্থা নিতে হবে।

সাবেক তত্ত্বাবধায়ক সরকারের উপদেষ্টা রাশেদা কে চৌধুরী বলেন, শিক্ষা-সংস্কৃতি সবকিছুর ওপর আঘাত এসেছে। তিনি প্রশ্ন রাখেন, ‘ছায়ানট কেন ভাঙচুর হলো? ধর্মীয় সংখ্যালঘুদের ওপর কেন আক্রমণ আসছে?’ গত বছর সচিবালয় ঘেরাওয়ের সময় সরকার শক্ত হাতে দমন না করায় পরিস্থিতি এখন দেয়ালে পিঠ ঠেকে যাওয়ার মতো অবস্থায় পৌঁছেছে।

নাগরিক ঐক্যের সভাপতি মাহমুদুর রহমান মান্না ও গণসংহতি আন্দোলনের প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি হামলার ঘটনাকে ‘পরিকল্পিত’ হিসেবে উল্লেখ করেন। তারা বলেন, জুলাই গণ-অভ্যুত্থানের স্লোগান ব্যবহার করে সংবাদমাধ্যমে হামলা চরম দুর্ভাগ্যজনক। সরকারের এই নীরবতা তাদের বৈধতাকে প্রশ্নবিদ্ধ করবে।

জামায়াতে ইসলামীর সহ-সম্পাদক জুবায়ের বলেন, এই হামলা কোনোভাবেই মেনে নেয়া যায় না। তিনি অন্তর্বর্তীকালীন সরকারের দায়িত্ব পালনে ব্যর্থতার অভিযোগ তুলে বলেন, দোষীদের শনাক্ত করে আইনের আওতায় আনতে হবে। জাতীয় ঐক্যের কোনো বিকল্প নেই।

সভায় আরো বক্তব্য দেন আলোকচিত্রী শহিদুল আলম, ব্যারিস্টার সারা হোসেন, মানবাধিকারকর্মী রেহনুমা আহমেদ, টিআইবির নির্বাহী পরিচালক ড. ইফতেখারুজ্জামানসহ বিভিন্ন রাজনৈতিক ও নাগরিক সংগঠনের প্রতিনিধিরা।

বক্তারা একযোগে বলেন, গণমাধ্যমের স্বাধীনতা রক্ষা ও গণতন্ত্রের বিকাশে সাংবাদিক, লেখক, বুদ্ধিজীবী এবং সব পেশাজীবী মানুষের ঐক্যবদ্ধ প্রতিরোধ এখন আমাদের সময়ের দাবি।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন