নারায়ণগঞ্জে সহাবস্থানে থেকে নজিরবিহীন দৃষ্টান্ত স্থাপন করেছে রাজনৈতিক দলগুলো



নিজস্ব প্রতিবেদক : রাজনৈতিক উত্তেজনার সময়েও সহাবস্থানের বিরল দৃষ্টান্তের সৃষ্টি  করলো নারায়ণগঞ্জের রাজনীতি। 
প্রাচ্যের ড্যান্ডি খ্যাত দেশের অন্যতম শিল্প নগরী নারায়ণগঞ্জ শহরে শুক্রবার (১৮ জুলাই) একদিনেই পাঁচটি ভিন্ন ভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি অনুষ্ঠিত হয়েছে, যার মধ্যে প্রতিটি দলের কর্মসূচিতেই ছিল  উল্লেখযোগ্য জনসমাগমে ভরপুর এবং সম্পূর্ণ শান্তিপূর্ণ। 

দুপুরের পর থেকে সন্ধ্যা পর্যন্ত প্রায় দুই কিলোমিটার এলাকাজুড়ে একসঙ্গে চলেছে বাংলাদেশ জাতীয়তাবাদী দল (বিএনপি), জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি), বাংলাদেশ জামায়াতে ইসলামী, গণসংহতি আন্দোলন ও ইসলামী আন্দোলনসহ বাংলাদেশের বিভিন্ন রাজনৈতিক দলের কর্মসূচি। 

উল্লেখযোগ্য বিষয় হলো এতগুলো দল একই সময়ে মাঠে থাকলেও কোথাও কোনো সংঘর্ষ, বিশৃঙ্খলা বা কোনো প্রকার অপ্রীতিকর ঘটনা ঘটেনি। শহরের দুই কিলোমিটার এলাকার মধ্যে একই সময়ে কর্মসূচির আয়োজন করা হলেও কোনো প্রকার বিশৃঙ্খলা ছাড়াই শান্তিপূর্ণভাবে তাদের কর্মসূচি সফল করেছে। 

স্থানীয়দের মতে, এটি নারায়ণগঞ্জে সহাবস্থানের রাজনীতির এক অনন্য দৃষ্টান্ত। কেউ কেউ এটিকে রাজনৈতিক পরিপক্বতার একটি নতুন শুভ সূচনা বলেও আখ্যায়িত করছেন। 

আইনশৃঙ্খলা বাহিনীর কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থা এবং সমন্বিত প্রস্তুতিকে এমন একটি শান্তিপূর্ণ পরিবেশ বজায় রাখার জন্য নারায়ণগঞ্জের প্রশাসনকেই কৃতিত্ব দিচ্ছেন নারায়ণগঞ্জবাসী।

২০২৪ এর জুলাই,আগস্টের ছাত্রজনতার গণঅভ্যুত্থানে আওয়ামীলীগের বিরুদ্ধে একটি অদৃশ্য জোট গড়েছিল দেশের প্রতিটি  রাজনৈতিক দল।

রাজনৈতিক মতপার্থক্যের ঊর্ধ্বে থেকে এদেশের নতুন প্রজন্ম থেকে শুরুকরে প্রতিটি রাজনৈতিক ব্যক্তি  ‘ফ্যাসিবাদের’ বিরুদ্ধে লড়েছিল হাতে হাত রেখে, কিন্তু জুলাই আগস্টের গণঅভ্যুত্থানের কয়েক মাস পরই যখন ভোটের রাজনীতির হিসেব নিকেশ চলে আসলো,তখনই দিন দিন  সম্পর্কের অবনতি লক্ষ্য করা যাচ্ছে রাজনৈতিক দলগুলোর মধ্যে। 

বর্তমানে জাতীয় রাজানীতির হিসেব-নিকেশ স্থানীয় পর্যায়েও চলে এসেছে। রাজনৈতিক নেতারা একে-অপরকে ঘায়েল করে প্রকাশ্যে বক্তব্যও দিচ্ছেন।

এমন পরিস্থিতিতে একইদিনে রাজনৈতিক কর্মসূচি ঘোষণা করে বিএনপি, এনসিপি, জামায়াতে ইসলামী, গণসংহতি আন্দোলন ও ইসলামী আন্দোলন এবং  প্রায় কাছাকাছি স্থানে সমাবেশ অনুষ্ঠিত হলেও কোনো রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীদের সঙ্গে কোনো প্রকার বাকবিতন্ডা বা বিশৃঙ্খলার সৃষ্টি  হয়নি।

গণঅভ্যুত্থানে নেতৃত্ব দেওয়া তরুণদের সমন্বয়ে গঠিত নতুন রাজনৈতিক দল জাতীয় নাগরিক পার্টি (এনসিপি) তাদের জুলাই পদযাত্রা কর্মসূচি নারায়ণগঞ্জ থেকেই ঘোষণা করে। 
নগরীর নিতাইগঞ্জ মোড় থেকে পায়ে হেঁটে হাজারো নেতা-কর্মীকে নিয়ে চাষাঢ়ায় এসো জড়ো হন দলটির কেন্দ্রীয় নেতারা।

এ সময় উপস্থিত ছিলেন দলটির প্রধান ও অন্তর্বর্তী সরকারের সাবেক উপদেষ্টা নাহিদ ইসলাম, সদস্য সচিব আখতার হোসেন, মুখ্য সমন্বয়ক নাসির উদ্দিন পাটোয়ারী, যুগ্ম আহ্বায়ক সামান্তা শারমিন, সিনিয়র যুগ্ম সদস্যসচিব ডা. তাসনিম জারা, যুগ্ম সদস্যসচিব আব্দুল্লাহ আল আমিন, উত্তরাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক সার্জিস আলম, দক্ষিণাঞ্চলের মুখ্য সংগঠক হাসনাত আব্দুল্লাহ, দক্ষিণাঞ্চলের সংগঠক শওকত আলী, নারায়ণগঞ্জ জেলার যুগ্ম সমন্বয়কারী আহমেদুর রহমান তনু প্রমুখ।

সন্ধ্যা সাড়ে ছয়টার দিকে পদযাত্রা শেষ করে এনসিপির গাড়িবহর চাষাঢ়া-আদমজীনগর সড়ক হয়ে ঢাকা-চট্টগ্রাম মহাসড়ক হয়ে চট্টগ্রামের উদ্দেশ্যে রওয়ানা করেন।

এনসিপির সমাবেশ যখন চাষাঢ়া চত্ত্বরে চলছিল তখন পাশেই শহীদ মিনারে চলছিল গণসংহতি আন্দোলনের জুলাই সমাবেশ। এতে প্রধান অতিথি ছিলেন দলটির প্রধান সমন্বয়কারী জোনায়েদ সাকি।

একই সময়ে এক কিলোমিটার দূরত্বে শহরের ডিআইটি এলাকায় চলে ইসলামী আন্দোলনের সমাবেশ। যেখানে হাজারো নেতা-কর্মীর উপস্থিতি লক্ষ্য করা গেছে।
 ইসলামী আন্দোলনের এই সমাবেশে প্রধান অতিথি ছিলেন দলটির আমীর ও চরমোনাই পীর মুফতি সৈয়দ মুহাম্মাদ রেজাউল করীম।

অন্যদিকে দুপুরে জামায়াতে ইসলামীর নারায়ণগঞ্জ মহানগরের নেতা-কর্মীরা শহরে মিছিল করেন। দলটির দেয়া তথ্যমতে, শনিবার ঢাকায় দলটির মহাসমাবেশ উপলক্ষে এ মিছিল করেন তারা।

বিকেলে চাষাঢ়ার পাশে মিশনপাড়ায় ছিল বিএনপির কর্মসূচি। দলটির নারায়ণগঞ্জ মহানগর শাখার নেতা-কর্মীরা জুলাই শহীদদের স্মরণে শহরে একটি মৌন মিছিল বের করেন।

পাঁচটি দলের এই কর্মসূচিকে ঘিরে শহরে বিশৃঙ্খলার আশঙ্কা থাকলেও এমন কোনো ঘটনা সারাদিনে ঘটেনি,বরং শান্তিপূর্ণভাবেই সম্পন্ন হয়েছে প্রতিটি কর্মসূচি।
পাঁচটি রাজনৈতিক কর্মসূচিকে কেন্দ্র করে শহরে যাতে কোনো বিশৃঙ্খলা না ঘটে, সেজন্য প্রশাসন ছিল তৎপর। 

শহরজুড়ে কড়া নিরাপত্তা ব্যবস্থায় তৎপর ছিল আইনশৃঙ্খলা বাহিনী। 

গুরুত্বপূর্ণ মোড়ে মোড়ে অতিরিক্ত পুলিশ মোতায়েন করা হয়, পাশাপাশি নিরাপত্তা জোরদারে বিজিবিও প্রশংসনীয় ভূমিকা  রেখেছে। 

রাজনৈতিক দলগুলোর এই শৃঙ্খলাবদ্ধ ও সহনশীল অবস্থান একদিকে যেমন ইতিবাচক বার্তা দিয়েছে, অন্যদিকে প্রশংসাও কুড়িয়েছে সাধারণ মানুষের কাছে।
প্রশাসনিক দৃষ্টিকোণ থেকেও এটি একটি সফল নিরাপত্তা ব্যবস্থাপনার উদাহরণ হিসেবে দেখা হচ্ছে।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন