চূড়ান্ত মনোনয়ন পাবেন কাজী সালাউদ্দিন, আসলাম চৌধুরীর অধ্যায় শেষের দিকে



নিজস্ব প্রতিবেদক

চট্টগ্রাম–৪ (সীতাকুণ্ড, আকবর শাহ-পাহাড়তলী-খুলশী আংশিক) আসনের রাজনৈতিক বাস্তবতা এখন খুব স্পষ্ট। বিএনপি তিন নভেম্বর ২০২৫ ইংরেজি তারিখে যে ২৩৭টি প্রাথমিক মনোনয়ন ঘোষণা করেছে, সেখানে এই আসনে ধানের শীষের প্রার্থী হিসেবে উঠে এসেছে দীর্ঘদিন মাঠে থাকা, তৃণমূলের আস্থাভাজন, উত্তর জেলা বিএনপি’র সাবেক যুগ্ম আহ্বায়ক কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের নাম। এই ঘোষণা কার্যত বুঝিয়ে দিল—অধ্যাপক আসলাম চৌধুরী আর মনোনয়ন দৌড়ের ভেতর নেই।


সালাউদ্দিনের মনোনয়ন পাওয়া অপ্রত্যাশিত কিছু নয়। ১৯৮৬ সালে ছাত্রদল থেকে শুরু করে সীতাকুণ্ড ডিগ্রী কলেজ ছাত্রদল, উপজেলা ছাত্রদল, উপজেলা যুবদল, পরে জেলা যুবদল এবং সর্বশেষ উত্তর জেলা বিএনপি—প্রতিটি ধাপে তিনি সক্রিয় ছিলেন, মাঠে ছিলেন, কর্মীদের পাশে ছিলেন। আন্দোলন-সংগ্রামের কঠিন সময়ে নথিভুক্ত ভূমিকা, গ্রেপ্তার-ঝুঁকি মাথায় নিয়ে রাস্তায় থাকা, আর তৃণমূলের সঙ্গে তার জীবন্ত সম্পর্ক—এসব কারণে দলীয় মূল্যায়নে তিনি এগিয়ে ছিলেন শুরু থেকেই।


অপরদিকে আসলাম চৌধুরীর অবস্থান পুরোপুরি বিপরীত দিকে ঘুরে গেছে। দীর্ঘ সাড়ে আট বছর কারাভোগের পর ২০ আগস্ট ২০২৪ সালে মুক্তি পাওয়ার পর তিনি কোনো মিছিল, সমাবেশ বা সংগঠনিক কর্মসূচিতে অংশ নেননি। বরং যেসব সামাজিক অনুষ্ঠানে তিনি অংশ নিয়েছেন, সেগুলোর ব্যানারে বিএনপির নাম, প্রতীক, এমনকি কোনো সিনিয়র নেতার ছবি পর্যন্ত ছিল না। দলীয় কর্মসূচিতে তাকে বারবার ডাকা হলেও তিনি ব্যানারে বিএনপি বা নেতাদের ছবি থাকলে উপস্থিত না থাকার শর্ত দেন। আগস্ট বিপ্লবের এক বছর পূর্তি উপলক্ষে আয়োজিত বড় কর্মসূচিতে যোগ দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিয়েও শেষ মুহূর্তে ঢাকায় আছেন বলে জানিয়ে চলে যান।


এদিকে নিজের দৈনিক আমার দেশ পত্রিকার সাক্ষাৎকারে “বিএনপি ক্ষমতায় আসতে পারেনি হাইকমান্ডের ভুল সিদ্ধান্তের কারণে” এমন মন্তব্য করে তিনি দলীয় শৃঙ্খলার বাইরে চলে যান। চট্টগ্রাম বিশ্ববিদ্যালয় অ্যালামনাই অ্যাসোসিয়েশন নিয়ে হঠাৎ নিজের নামে নতুন কমিটি ঘোষণা করে ব্যাপক বিতর্ক সৃষ্টি করেন; বিএনপি-ঘনিষ্ঠ সাবেক ছাত্রনেতারা ক্ষুব্ধ প্রতিক্রিয়া জানান। মাঠপর্যায়ের কোনো সংকট, সভা, পরামর্শ—কোনো ক্ষেত্রেই তার ভূমিকা নেই। এমনকি সীতাকুণ্ডে সংঘর্ষ, হত্যা, দফায় দফায় গ্রুপিং—সব সময়ই তিনি নীরব পর্যবেক্ষক হয়েই থেকে গেছেন।


তার ওপর নতুন রাজনৈতিক দল গঠনের আলোচনা, ব্যানার-পোস্টার, ঘনিষ্ঠজনদের ইঙ্গিত—এসব বিষয় কেন্দ্রীয় মূল্যায়নে নেতিবাচক প্রভাব ফেলেছে। ফলে বিএনপির অভ্যন্তরীণ গোয়েন্দা রিপোর্টে তার নাম এখন “রাজনৈতিকভাবে অনির্ভরযোগ্য” তালিকায় রয়েছে। সব মিলিয়ে মনোনয়ন বোর্ড তাকে আর বিবেচনায় রাখেনি।


এছাড়াও, বিগত এক বছরে আসলাম চৌধুরী ও তার পরিবারের কয়েকজনকে ঘিরে নতুন বিতর্ক উঠেছে। স্থানীয় সূত্র বলছে, সীতাকুণ্ড পৌরসভা ও ইউনিয়ন পরিষদের বিভিন্ন টেন্ডার কার্যক্রমে তার পরিবারের লোকজনের যুক্ত থাকার অভিযোগ রয়েছে। স্কুল কলেজসহ অনেক শিক্ষা প্রতিষ্ঠানে তিনি নিজে এবং তার পরিবারের লোকজনকে এবং তার ঘনিষ্ঠজনদেরকে দায়িত্ব পাইয়ে দিয়েছেন কিন্তু যারা দলের ত্যাগী তাদের বিষয়ে তিনি কোন চিন্তা করেননি, এছাড়াও কুমিরা এলাকায় সমুদ্র থেকে বালু উত্তোলন, বিভিন্ন মিল ফ্যাক্টরিসহ আনাচে-কানাচে টেন্ডারের সঙ্গে সংশ্লিষ্টতার কথাও উঠেছে। তাছাড়া অভিযোগ আছে, আসলাম চৌধুরী এবং তার পরিবারের সদস্যরা বিভিন্ন ব্যক্তির কাছ থেকে নগদে ধার নিয়েছেন, যা নিয়েও স্থানীয়দের মধ্যে অসন্তোষ আছে। যদিও কিছু লোক নগদ অর্থের কারণে তার পাশে ভিড়াচ্ছে, প্রকৃত তৃণমূলের নেতা এবং কর্মীরা স্পষ্টভাবে কাজী সালাউদ্দিনের পাশে আছে।


এই পুরো প্রেক্ষাপটে কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিনের অবস্থান আরও শক্ত হয়েছে। তৃণমূলের কর্মীরা জানে, আন্দোলনের কঠিন দিনগুলোতে তিনি সামনে ছিলেন, কর্মসূচিতে নেতৃত্ব দিয়েছেন, গ্রেপ্তার-ঝুঁকির সময়ও মাঠ ছাড়েননি। হাইকমান্ডও পরিষ্কারভাবে দেখছে—এই আসনে দলের সংগঠিত শক্তি ধরে রাখতে চাইলে মাঠ-পরীক্ষিত নেতৃত্বের ওপর ভরসা করাই একমাত্র পথ। আর এই মানদণ্ডে সালাউদ্দিনের বিকল্প নেই।


সব মিলিয়ে এখন উত্তর চট্টগ্রামে যে চিত্র দাঁড়িয়েছে তা একেবারে স্বচ্ছ। একসময়ের প্রভাবশালী আসলাম চৌধুরী আজ মনোনয়ন আলোচনার সম্পূর্ণ বাইরে দাঁড়িয়ে, আর কাজী মোহাম্মদ সালাউদ্দিন এগিয়ে চলেছেন ধানের শীষের চূড়ান্ত প্রার্থী হিসেবে ঘোষিত হওয়ার পথেই।

একটি মন্তব্য পোস্ট করুন

নবীনতর পূর্বতন